পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বাদশ খণ্ড).pdf/৩৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংরাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ দ্বাদশ খণ্ড
৩১৯

করিয়াছেন। পাকিস্তানের অন্যান্য বাঙালি অফিসার এবং কর্মীরা, নাবিক ও লস্কররাও একে একে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করিতেছেন। ওদিকে স্বাধীন বাংলাদেশ সার্বভৌম অধিকার সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালিকে এক নূতন রাষ্ট্রিক ঐক্যের মধ্যে সংহত করিতে চলিয়াছে। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অধিবাসীর অন্ততঃ শতকরা ৯৫ জন এই নূতন রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত। তারা পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীকে এবং তার নৃশংস নরঘাতী শাসনকে অপরিসীম ঘৃণায় উপক্ষো ও অগ্রাহ্য করিয়াছেন। অর্থাৎ এতটি সংহত স্বাধীন নতুন রাষ্ট্রের রূপরেখা বাস্তব মূর্তি ধারণ করিয়াছে।

 উপরে পর পর এই নাটকীয় ঘটনাবলীর কথা আমরা উল্লেখ করিলাম এই জন্য যে, একটি নতুন সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য যে, যে অবস্থার উদ্ভব প্রয়োজন, সীমান্তের গুলি দেখা গিয়াছে। সুতরাং ভারত সরকার কেন অবিলম্বে এই নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতেছে না, এটাই আমাদের সবচেয়ে জরুরী জিজ্ঞাস্য। নয়াদিল্লীর কর্তারা কি এখনও তীরে দাঁড়াইয়া আরব সাগরের ঢেউ গুনিবেন? বাংলাদেশে যখন প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষকে খুন করা হইতেছে, নারী-শিশু-বৃদ্ধ এবং বুদ্ধিজীবী নির্বিশেষে পাইকারি নরঘাতন পর্ব চলিতেছে এবং মুক্তিফৌজ যখন অমিত বিক্রম সত্ত্বেও শহরে শহরে মারণাস্ত্র সজ্জিত মডার্ন আর্মকে ঠেকাইয়া রাখিতে পারিতেছেন না, তখন যদি ভারত সরকার কেবল দ্বিধা দ্বন্ধ এবং সংকোচ ও ভয় নিয়া কালহরণ করিতে থাকেন, তবে সীমান্তের বিপদ আরও ভয়ঙ্কর হইয়া উঠিবে। ভারত সরকার এবং বিশেষভাবে প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেন মনে রাখেন যদি বাংলাদেশ এই জীবন-মৃত্যুর সংগ্রামে চূড়ান্ত পরাজয় মানিয়া লইতে বাধ্য হয়, তবে আগামী একশ বছরের মধ্যে পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ আর কোনদিন মাথা তুলিয়া দাঁড়াইতে পারিবে না। সেখানে সমস্ত গণতন্ত্রবাদী অসাম্প্রদায়িক মানুষের এবং বিশেষভাবে মাইনরিটিরা একেবারে শেষ হইয়া যাইবে এবং তারপর পকিস্তান ও চীন একজোট হইয়া ভারতবর্ষের ঘাড় মটকাইবার চেষ্টা করিবে-যে চেষ্টা চলিতেছে গত এক যুগ ধরিয়া। এই নিষ্ঠুর বাস্তব সত্য আমাদের প্রধানমন্ত্রী কিভাবে উপেক্ষা করিতে পারেন এবং কিভাবেই বা ভুলিয়া যাইতে পারেন যে, গত ১৯৪৬ সাল হইতে যে ভায়বহ সাম্প্রদায়িক তাণ্ডব চলিতেছে, যার ফলে ভারতবর্ষকে কাটিয়া দুই টুকরা করিতে হইল এবং তারপর থেকে ২৪/২৫ বছর ধরিয়া আমরা নিরন্তর যে যন্ত্রণায় ভুগিতেছি, আজ সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ উপস্থিত। স্বাধীন বাংলাদেশ পাকিস্তানী যন্ত্রণা ও বর্বরতার পাল্টা লইতেছেপ্রায় নিরস্ত্র, একক প্রতিরোধ শক্তির দ্বারা। আর আমরা কি এই পাকিস্তানী উৎপাত ও শয়তানীকে বধ করিবার জন্য বাংলাদেশের মুক্তি ফৌজের প্রতি হাত বাড়াইয়া দিব না-সেই শক্ত হাতে কি আমরা কামান, বন্দুক ও অন্যান্য অস্ত্র তুলিয়া দিব না? কিসের ভয়, কিসের দ্বিধা, কিসের এত সংকোচ? আজ যদি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও ভারত সরকার নূতন বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেন, তবে আগামীকাল সোভিয়েট রাশিয়া অগ্রসর হইয়া আসিবে কিন্তু ভারত সরকার ও প্রধানমন্ত্রী কি আশা করেন যে, আমাদের কর্তব্য ও দায়িত্ব আমরা পালন করিব না কিন্তু আশা করিব যে সোভিয়েট রাশিয়া ও আমেরিকা আসিয়া আমাদের উদ্ধার করিবে? যে সাহসী, যে বীর তাকেই পৃথিবীর লোকে সম্মান করে। আজ আন্তর্জাতিক জগতে ভারতবর্ষের চেহারা নিষ্প্রভ হইয়া গিয়াছে। কিন্তু ভারত সরকার যদি বাংলাদেশের পাশে আজ সাহসের সঙ্গে দণ্ডায়মান হন তবে সেই শক্তিমান ও সাহসী ভারতবর্ষকে পৃথিবীর লোকে আবার সম্মান করিবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার সরণ সিং যেন মনে রাখেন তার এই দুর্বল পররাষ্ট্রনীতির গোজালি কোথাও শ্রদ্ধা উদ্রেক করিতেছে না। আজ যদি তিনি ও তার দপ্তর বাংলাদেশের সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেন তবে কালই আফ্রো-এশীয় দেশগুলিতে ভারতবর্ষ সম্পর্কে নতুন মমত্ববোধ শুরু হইবে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমগ্র পরিস্থিতি সহানভূতির সঙ্গে বিবেচনা করিবে। আর প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রী বগজীবন রামের উদ্দেশ্যে বলিতেছি-পার্টিশনের পর থেকেই ভারতবর্ষ দুই ফ্রণ্টের বেকায়দায় পড়িয়াছে। একদিকে পাকিস্তানী এবং অন্যদিকে চৈনিক আক্রমণের আশঙ্কা (তাঁরা নিজেরাই মাঝে মাঝে এজন্য হাঁক-ডাক ছাড়িতেছেন)-এই দুই ফ্রণ্টের বিপদ কাটিয়া যাইবে যদি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে। পাকিস্তান ও চীনের একত্র যোগসাজশে ভারতবর্ষের উপর বিষম চাপ সৃষ্টি হইতেছে এবং হাজার কোটি টাকা মিলিটারি বাবদ ব্যয়