পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বাদশ খণ্ড).pdf/৪০৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংরাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ দ্বাদশ খণ্ড
৩৮০

 ১৬। রাজনৈতিক, আর্থিক এবং সামরিক- কোনদিক থেকেই পাকিস্তানের পক্ষে ভারতের সঙ্গে বর্তমানে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া সম্ভব নয়। পূর্বাঞ্চলে একটি গোটা জাতি বিদ্রোহ করেছে পাক-ফৌজের বিরূদ্ধে। পাক-ফৌজ রণনৈতিক স্ট্র্যাটিজির দিক থেকে শুধু যে একটি সামগ্রিক বৈরী জনতার ঘেরাওয়ে আবদ্ধ রয়েছে তাই নয়- এই ফৌজ গণ সংগ্রামে- দমনের উদ্দেশ্যে মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। পূর্বাঞ্চল সরবরাহ ও যোগাযোগের ব্যবস্থাও পাক-ফৌজের অনূকূল নয়। পশ্চিমাঞ্চল থেকে দুই ডিবিশন সৈন্য পূর্ববাংলায় পাঠাবার সঙ্গে পশ্চিম সীমান্তেও এ ফৌজের আক্রমন ক্ষমতা ব্যাহত হয়েছে। এরূপ পরিস্থিতি সত্ত্বেও যদি পাক ফৌজ কোন আক্রমণাত্মক দুঃসাহস দেখায় তাহলে দুই সীমান্তেই এই ফৌজের আশু বিপর্যয় সুনিশ্চিত। পূর্বাঞ্চালে পাক- ফৌজের পক্ষে এ সপ্তাহ টিকে থাকাও সম্ভাব নয়। পূর্বাঞ্চাল পতনের পরে ভারতীয় ফৌজকে পশ্চিমাঞ্চলে পাঠিয়ে পশ্চিম প্রান্তকে শক্তিশালী করা ভারতের পক্ষে কষ্টসাধ্য হবে না। পাক ফৌজের পক্ষে এরূপ সম্ভাব্য পরিণতির কথা অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয় বলেই এই সিদ্ধান্ত করা যায় যে আত্ম হত্যার পথ বেছে নেওয়ার অ্যাডভেঞ্চার করতে উদ্যত না হলে, পাকিস্তানের পক্ষে বর্তমান অবস্থায় প্রত্যক্ষ সংঘর্ষের ঝুকি নেওয়া সম্ভব নয়।

চীন আসেনি

 ১৭। রাশিয়ার সম্মতি ও সাহচর্যে চীনা ফৌজ করিয়ায় প্রবেশ করেছিল। কিন্তু ভিয়েতমান, লাওস বা ক্যাম্বোডিয়ার প্রতিবেশী রাষ্ট্রে চীনের জাতীয় স্বার্থ গভীরভাবে জড়িত থাকা সত্ত্বেও প্রত্যক্ষভাবে চীন এই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেনি। অস্ত্র সরবরাহ চীন এদেশগুলিকেও করেছে পাকিস্তানকেও করেছে। চীন বার বার হুমকি দেওয়া সত্ত্বেও বিশ্বের কোন অঞ্চলের সামরিক সংঘাতে প্রত্যক্ষভাবে অংশীদার হয়নি। তা ছাড়া চীন জানে যে, আসন্ন বর্ষার সময়ে পূর্ব বাংলায় বা পূর্বাঞ্চল ভারতের কোন প্রান্তে বড় রকমের সৈন্য চলাচল করা এক দুঃসাধ্য প্রচেষ্টায় পরিণত হতে বাধ্য। চীন একথাও জানে যে ভারত বাংলাদেশের স্বীকৃতি দানের প্রশ্নে রুশ-মার্কিন সমর্থন ও সহযোগিতা থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও চীন যদি -পাকিস্তানের খাতিরে ভারতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে অবর্তীন হয় তা হলে রুশ বা মার্কিন রাষ্ট্র নীরব দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করে দুরে সরে থাকতে পারবে না। চীন- মার্কিন সমঝোতার সম্ভাবনাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে চীন পাকিস্তান রক্ষায় নিজের জাতীয় স্বার্থকে বিপন্ন করবে, এরূপ আন্তর্জাতিক ঔদার্য আদর্শবাদী প্রতিচ্ছবি যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কিভাবে কলঙ্কিত হবে, সে কথাও চীনকে বিবেচনা করতে হবে।

 ১৮। তাই সমগ্রভাবে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো অযৌক্তিক নয় যে, পাকিস্তান বা পাক-চীনের পক্ষে ভারত-বিরোধী আক্রমণাত্মক ভূমিকা গ্রহণের ক্ষেত্র বর্তমানে অনুকূল নয়।

 ১৯। বিরোধী পক্ষের সঙ্গে বৈঠকে একজন মন্ত্রী বলেন যে, স্বীকৃতি না দিয়েও বাংলাদেশকে সাহায্য দেওয়া যায়। হ্যাঁ সাহায্য দেওয়া যায় অপ্রকাশ্যে গোপনে। কিন্তু ভারতের ন্যায় গণতান্তিক দেশে এরূপ সাহায্য গোপন রাখা সম্ভব নয় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ন্যায় বিরাট কাজে এরূপ প্রচেষ্টা সাহায্যদাতা ও গ্রহীতা কারও পক্ষেই যথার্থ কার্যকর করা যায় না।

 ২০। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হয়েছে যে, ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েই এই দেশের পক্ষে সরকার আন্তর্জাতীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা লাভে সক্ষম হবে না। এ কথা সত্য হলে সেই সঙ্গে অন্য কথাও সত্য হবে যে একটা রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করার ফলে বাংলাদেশের সরকার যে মর্যাদা লাভ করবে তার ভিত্তিতে আন্তর্জাতীয় প্রচার চালিয়ে ভারতে মতামত স্থাপন করে অন্যান্য রাষ্ট্রের স্বীকৃতি অর্জনের পথও সুগম করতে সক্ষম হবে।