পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বাদশ খণ্ড).pdf/৪৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংরাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ দ্বাদশ খণ্ড
৪১৬

বর্তমান বিপ্লব সম্পর্কে এর নীতি দ্বিধাগ্রস্থ ও অস্পষ্ট। কিন্তু তাতেও পাকিস্তানী জঙ্গী বাহিনীর হাতে এক মার খেতে হয়েছে।

 মুক্তিফৌজের নেতাদের মধ্যে কারু কারু অভিমত যে জমি ও শিল্প নিয়ন্ত্রণ জাতীয় শ্রমিক কৃষকদের নিজস্ব দাবী মেনে নিলে ভারতে শরণার্থীদের সংখ্যা কিছু কম হতো। প্রকৃত চাষীদের মধ্যে জমি বেটে দেওয়ার কথা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে এখনো ঘোষণা করা সম্ভব। শিল্প ও অন্যান্য শ্রমিক এরা অনেকেই স্বদেশ ছেড়ে এদেশে আসেনি ও মাধ্যম শ্রেণী স্বার্থ পোষণ কার্যক্রম গ্রহন করতে রাজি নন। তাঁদের যুক্তি এ কাজ করলে মুক্তি ফৌজের মধ্যে অন্তর্বিরোধ দেখা দেবে। এর অর্থ হলো জোতদার, ব্যবসায়ী, দোকানী ও সম্পত্তিশালী ব্যক্তিরা যাঁরা এখন আওয়ামী লীগের সমর্থক তাঁরা লীগ গড়া ছেড়ে দিতে পারেন। আওয়ামী লীগের নেতারা বামপন্থীদের আরও একটি দাবী মানতে রাজী নন। বামপন্থীরা চেয়েছিলেন সমস্ত প্রতিরোধকারী শক্তিদের নিয়ে জাতীয় মুক্তিফ্রণ্ট হোক। দাবী প্রত্যাখ্যানের যুক্তি জনগণের সমর্থন শুধু আওয়ামী লীগেরই আছে।

 বাংলাদেশ জাতীয় শ্রমিক লীগের অস্থায়ী সভাপতি মহম্মদ শাজাহান বলেন, বাংলাদেশ সংঘবদ্ধ শিল্প শ্রমিকর সংখ্যা প্রায় ৪০ লক্ষ। এদের মধ্যে বেশীর ভাগই ইউনিয়নের সদস্য। সামরিক শাসন বাধা দিতে পারেনি। এক লাখের উপর শ্রমিক পাকিস্তানী জঙ্গী বাহিনরি সঙ্গে যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে। তাঁর বক্তব্য ১৯৭৬ সালে আওয়ামী লীগ নারা লাগান যার জমি তার। ১৯৭০ সালে ঢাকার মে দিবস সমাবেশে শেখ মুজিব যে বাণী পাঠান তাতে একথা বলা ছিল, সেদিন আর দূরে নয় যেদিন শ্রমিকরাই হবে উৎপাদন শক্তির মালিক এর উপর সামাজিক কর্তৃত্ব স্থাপনের প্রধান ধাপ হিসেবে তিনি ব্যাংক, ইনসিওরেন্স কোম্পানী, পাট রফতানী ব্যবসায়ী, মূল শিল্পসমূহ ও জনস্বার্থ সম্পৃক্ত সেবা প্রতিষ্ঠান প্রভৃতির রাষ্ট্রীয়করণ সমর্থন করেন। আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো ন্যায়ভিত্তিক সাম্যবাদী সমাজ গঠনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে আস্থাশীল। প্রথম প্রদক্ষেপ হিসাবে কোন কোন শিল্প ব্যক্তিগত মালিকানা লোপ করা হবে তারও ফিরিস্তি আছে ম্যানিফেস্টোতে।

 উপরন্তু মুজিব নাকি ৭ই মার্চ তারিখে নির্দেশ দেন যে আওয়ামী লীগের নেতারা হঠাৎ গ্রেফতার বা নিহত হলে জনগণ যে বিভিন্ন মতাবলম্বী লোকদের নিয়ে বিভিন্ন স্তরে কর্মপরিষদ গড়ে ফেলে। সর্বতোভাবে পাক সৈন্যদের সঙ্গে অসহযোগ করে রেল ও সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা বানচাল করে দিয়ে এবং প্রত্যেক গ্রামকে প্রতিরোধের দুর্গে পরিণত করে।

 বিদ্রোহী জনগন এ নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন ঘোষণার বিপ্লবের এ জাতীয় ভবিষ্যৎ পরিণতির কোনো আভাস বা ইঙ্গিত নেই। বাংলাদেশের বিপ্লবী বামপন্থীদের এ খুঁত, এ ত্রুটি দুর করতে হবে।

 এ প্রসঙ্গে বলা যায় যে, পাক সৈন্যদের নৃশংসতা বন্ধ করতে হলে চাই জনগণের হাতে অস্ত্র। আত্মরক্ষার জন্য জনগনের হাতে তুলে দিতে হবে হাতিয়ার। সমস্ত গণবিপ্লবেই এমন একটা সময় আসে যখন জনগনের হাতে হাতিয়ার তুলে দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায়ই বিপ্লবকে বাঁচান যায় না। বর্তমান ও পাকিস্তানী সেনাবাহিণীর সন্ত্রাসের জবাব দেবার এবং জনগনের মনোবল দৃঢ় করার জন্য চাই জনতাকে সশস্ত্র করা। আজ মুক্তিফৌজে আছে ৩০,০০০ সৈনিক। আরও ৩০,০০০- এর চলছে শিক্ষা পর্ব।

 মুক্তিফৌজের নেতাদের আজ কাজ হলো গেরিলা আক্রমণের সঙ্গে স্থানীয় জনগণের প্রতিরোধের সমন্বয় ঘটান। জনগনের সক্রিয় সহযোগ ছাড়া শুধু গেরিলা আক্রমণ মারফত বিপ্লবের বিস্তৃতি ঘটান সম্ভব নয়। জনগণকে এমন কিছু দিতে হবে যার জন্য তারা লড়তে ও মরতে রাজী হয়। শুধু স্বাধীনতার নামে এ কাজ হয়