পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বাদশ খণ্ড).pdf/৪৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংরাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ দ্বাদশ খণ্ড
৪২০

বাংলাদেশের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আক্রমণ

 উনিশশ একাত্তর সনের ২৫ শে মার্চ বাংলাদেশের জনগণের সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী অমানুষিক গণহত্যা অভিযান শুরু করে। এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছে বাংলাদেশের সকল জনবসতি, স্কুল, কলেজ, ছাত্রাবাস, অধ্যাপক, শিক্ষক, উকিল এবং ডাক্তারগনসহ বুদ্ধিজীবীরা। লক্ষ লক্ষ মানুষ হয়েছে গৃহহারা, অত্যাচারের মুখে এক বিশাল জনস্রোত প্রবেশ করেছে আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং পশ্চিম বঙ্গে।

 সভ্যতার ইতিহাসে এই অত্যাচারের তুলনা নেই। চেংগিসখান আর হিচলারের বীভৎস হত্যাকাণ্ড ও ইয়াহিয়ার কাছে ম্লান হয়ে গেছে। এই বর্বরতার উদ্দেশ্য হলো পূর্ব বাংলার জাতীয়তাবাদী ও প্রগতিশীল শক্তিসমূহকে চিরকালের জন্য উৎখাত করা। হিন্দু মুসলমান সকল সম্প্রদায়ের ছাত্র যুবক বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করে পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের পূর্ণাঙ্গ উপনিবেশে পরিণত করাই ইয়াহিয়ার উদ্দেশ্য। পশ্চিম পাকিস্তানী জমিদার সামরিক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার সামন্তবিরোধী জাতীয়তাবাদী সংগ্রামকে ধবংস করতে পারলে পাকিস্তানের বালুচি সিন্ধি আর পাখতুনদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করাও সহজ হবে। কিন্তু ইয়াহিয়া চক্র অসাধ্য সাধনের চেষ্টা করছে, ইতিহাসের চাকাকে পেছনে ঘোরানো যায় না। পাকিস্তানী শাষক গোষ্ঠীর চব্বিশ বছরের অনুসৃত নীতির ঐতিহাসিক পরিণতিই বাংলাদেশের বর্তমান মুক্তি সংগ্রাম। পাকিস্তানের ধ্বংসের বর্তমান পর্যায়ের জন্য দায়ী ইয়াহিয়া চক্র এবং তার সাম্রাজ্যবাদী ও সামন্তবাদী মিত্ররা। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন এবং প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর ন্যায্য অধিকার স্বীকার না করে পাকিস্তান রক্ষা করা সম্ভব নয়।

মুক্তিযুদ্ধ সকলের সংগ্রাম

 পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর এই অকথ্য অত্যাচারের মুখে বাংলাদেশের জনগণ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। প্রথম অবস্থা ইস্ট বেঙ্গল রাইফেল, বেঙ্গল রেজিমেণ্ট আর পুলিশ বাহিনী পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করে। বর্তমানে হাজার যুবক মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করে ইতিমধ্যেই যুদ্ধ নেমে গেছে। তাদের পেছনে আছে ব্যাপক জনগণের সমর্থন। পাকিস্তানী বাহিনী জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। ভিয়েতনামে মার্কিনী এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামের সরকারী সৈন্যদের মতো তাদের অবস্থা মুক্তিবাহিনী ইতিমধ্যেই গেরিলা কৌশল অবলম্বন করে রাজধানী ঢাকার ওপর আঘাত হানা শুরু করেছে। তারা এখনো চূড়ান্ত আঘাত হানতে পারেনি এই জন্য যে মুক্তিবাহিনীর সেনারা নতুন এবং অনভিজ্ঞ, অন্যদিকে পাকিস্তানী বাহিনী আমেরিকা ও চীনের সাহায্যপুষ্ট এবং আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত। কিন্তু জনগণের সক্রিয় সমর্থনে মুক্তিবাহিনী যে চূড়ান্তভাবে বিজয়ী হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সুফল

 বাংলাদেশের জনগন আজ আধুনিক মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত এক পাশবিক শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। এই ঐক্য সম্ভব হয়েছে এ জন্য যে আওয়ামী লীগ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলসমূহ পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর হীন প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে হিন্দু মুসলীম অসাম্প্রদায়িক ঐক্য গড়ে তুলতে পেরেছে। এই সংগ্রামী ঐক্য ফাটল ধারানোর জন্য ইয়াহিয়া চক্র মুসলীম লীগ ও জামাত-ই-ইসলামীসহ সাম্প্রদায়িক দলসমূহকে দিয়ে প্রচষ্টা ব্যর্থ হয়েছে সে জন্য ইয়াহিয়া খান নতুন করে দালাল সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ভারতকে উস্কানি দিয়ে পৃথিবীর জনমতকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সীমান্তের সংঘর্ষ সৃষ্টি করছে।

 এই পরিস্তিতিতে আমাদের ওপর গুরুদায়িত্ব এসে পড়েছে। বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্র, মানবিক অধিকার ও শোষণের কবল থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। আমাদের দেশের জনগণও গণতন্ত্র, মানবিক অধিকার ও শোষণের কবল থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। আমাদের দেশের জনগণও গণতন্ত্র রক্ষা এবং শোষনহীন সমাজের জন্যে সংগ্রাম করে আসছে। তাই বাংলাদেশের সংগ্রাম সফল হলে তা আমাদেরও সহায়তা করবে। মুক্তি সংগ্রাম জয়যুক্ত হলে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক আর প্রতিক্রিয়ার শক্তি পরাজিত হবে, গনতন্ত্র