পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বাদশ খণ্ড).pdf/৪৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংরাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ দ্বাদশ খণ্ড
৪২১

প্রতিষ্ঠিত হবে এবং ফলে আমাদের দেশেও সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়ার শক্তি দুর্বল হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সংগ্রাম পরাজিত হলে উভয় দেশেই সাম্প্রদায়িক আর প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি মাথা তুলে দাঁড়াবে এবং ফলে আমাদের দেশে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বিপন্ন হবে। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হলে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠনের অলীক কল্পনা চিরকালের জন্য বিলুপ্ত হবে।

 গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের জন্ম হলে ভারতের সাথে উন্নত এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হবে। দুই দেশের মাঝে বাণিজ্যিক প্রসার ঘটবে। দেশ বিভাগের পরে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর ভারতবিরোধী মনোভাবের ফলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। আগে পূর্ব বঙ্গ থেকে আমদানীর ফলে মাছ ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য আসামে অনেক যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে সে বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আসাম ও মেঘালয় রাজ্যদ্বয় বিশেষভাবে লাভবান হবে। উদ্বাস্তুরাও সকলে ফিরে যাবে।

 বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম জয়যুক্ত হলে আমেরিকার যুদ্ধজোট আর চীনের চক্রান্ত ব্যর্থ হবে আমাদের সীমান্তবর্তী বাংলাদেশ হবে বন্ধুরাষ্ট্র এবং ফলে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তি আরো সফল হবে।

উদ্ধাস্তু সমস্যা

 পাকিস্তানী দস্যু বাহিনীর অকথ্য অত্যাচারের মুখে লক্ষ লক্ষ মানুষ বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে। আসাম আর মেঘালয়েই এসেছে কয়েক লক্ষ। এদের মধ্যে শিশু, নারী আর বৃদ্ধের সংখ্যাই বেশী। এই ছিন্নমূল সর্বস্বান্ত মানুষদের আশ্রয় ও সকল প্রকার সহযোগিতা করা আমাদের মানবিক কর্তব্য।

 এই লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু স্থায়ীভাবে থাকলে মানুষের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে আসাম ও মেঘালয়ের জনগণের মাঝেঝ এমনিতর ধারণা বদ্ধমূল হতে চলেছে। কিন্তু ভারত সরকার ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে যে উদ্বাস্তুদের সাময়িকভাবে রাখা হবে। বাংলাদেশ হলেই তাদের ফেরত পাঠানো হবে। উদ্বাস্তু সমস্যা এক জাতীয় সমস্যা। এ কথা বুঝতে হবে যে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম জয়যুক্ত হলেই কেবল তাদের ফেরত পাঠানোর মতো পরিবেশ সৃষ্টি হবে।

 পরিস্তিতি আমাদের ওপর দুটি দায়িত্ব এনে দিয়েছে। একদিকে উদ্বাস্তুদের রক্ষণাবেক্ষণ ও সাহায্য শুশ্রূষা করা এবং অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রশস্ত্র ও সমর্থন যোগানো, যাতে তারা সংগ্রামে জয়লাভ করতে পারে। ইতিমধ্যেই তারা বেশ কিছু সাফল্য অর্জন করেছে। আমাদের সক্রিয় সমর্থন পেলে তারা নিশ্চিতভাবেই বিজয়ী হবে। এ জন্যই আমাদের সকলকে এই সংগ্রামের সাফল্যের জন্য এগিয়ে আসতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন আমাদের মধ্যে ঐক্য ও শান্তি বজায় রাখা। আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হলে ইয়াহিয়া চক্রই লাভবান হবে। তাই সাম্প্রদায়িক ও বিভেদকামী শক্তির বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে।

 আমাদের সমর্থন ও সহযেগিতায় বাংলাদেশের সংগ্রামের অগ্রতির সাথে আন্তর্জাতিক সমর্থনও এগিয়ে আসবে। ইতিমধ্যেই প্রগতিশীল বহু রাষ্ট্র বাংলাদেশের জনগণের সমর্থণে এগিয়ে এসেছে। মার্কিনীরা ইয়াহিয়া চক্রকে সামরিক সাহায্য ও সমর্থন দিয়ে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীকে ইন্ধন যোগাচ্ছে। চীন সরকারও ইয়াহিয়া চক্রকে সমর্থন দিয়ে মুক্তি সংগ্রামের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। কিন্তু আমেরিকা ও চীনের এই চক্রান্ত সত্ত্বেও মুক্তিসংগ্রামের বিজয় সুনিশ্চিত। এই সংগ্রাম পাকিস্তানের ইতিহাসের এক অবধারিত পরিণতি। আর এর জন্য সম্পূর্ণরূপে দায়ী পাকিস্তানের শাষকগোষ্ঠী।

 বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম সমগ্র এশিয়ার জন্য এক ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এই সংগ্রাম স্বাধীনতা, গণতন্ত্র আর শোষন মুক্তির সংগ্রাম। এর বিজয় সুনিশ্চিত। এই বিজয় যত শীঘ্র হবে ততই আমাদের উভয় দেশের জন্যই মঙ্গল। আসুন, আমরা সকলে এই সংগ্রামকে সফল করার জন্য সঠিকভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করি।

(অসমীয় ভাষায় প্রকাশিত মূল গ্রন্থ থেকে সংক্ষেপে অনূদিত)