পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বাদশ খণ্ড).pdf/৫২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8ჯა\) বাংরাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ দ্বাদশ খন্ড সম্পর্কেও আমরা বধির থাকতে পারতাম। তাদের পূর্বাংশের উপনিবেশটিকে অমুসলামন বিশেষ করে হিন্দু শূন্য করা, যথেষ্ট সংখ্যায় বাঙালি মুসলমানকে খুন করে বা বিতাড়িত করে তাদের জায়গায় যথেষ্ট অনুগত পাকিস্তানী আমদানী করে বাঙালি সংখ্যালঘুতে পর্যবসিত করা এবং তার দ্বারা বাঙালি জাতীয়তাবাদকে নিস্ক্রিয় করে তোলা, মুসলিম জগতের সর্বোত্তম সাংস্কৃতিক উজ্জীবনকে ব্যর্থ করে দেখা, বাঙালি দেশপ্রেমিকদের কবরে দর্ম নিরপেক্ষতাকে চাপা দেওয়া এবং সর্বশেষ দ্বিজাতিতত্ত্বকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার পৈশাচিক ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আমরা আমাদের মনের দরজায় খিল দিয়ে রাখতেও পারতাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা হল বাংলাদেশ ভারতের পক্ষেই এক জীবন-মরণের প্রশ্ন। শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় এক কোটিতে পৌঁছেছে এবং সেই যে অন্যায়জনক পৌনঃপুনিক উক্তি- বাংলাদেশে এমন পরিবেশের সৃষ্টি করতে হবে যাতে শরণার্থীরা নিরাপদে ফিরে যেতে পারে তা সত্য করে তুলবার জন্য বিশ্বের দুই ভাগ্যবিধাতা রাশিয়া এবং আমেরিকা যদি পাকিস্তানকে সম্মত করাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে কালক্রমে শরণার্থী সংখ্যা আরো এক কোটি কিম্বা বেশি হতে পারে। কিন্তু এ শুধু শরণার্থী বহনের প্রশ্ন নয়। লোকস্ফিত ও দারিদ্র্যপীড়িত আমাদের দেশের ওপর ক্রমাগত এত বেশি শরণার্থীর চাপে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত কি পরিণাম অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে তা অতিবড় নির্বোধও উপলদ্ধি করতে পারে। সোজাসুজি সমস্যাটির মুখোমুখি হয়ে বুঝতে হবে পৃথিবীর অন্তত মুখ রক্ষার মত সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে ভারত টিকে থাকবে কিনা, বাংলাদেশ প্রশ্নটি তার চাইতে কিছু কম নয়। নিক্সন এবং পদগনি যদি না-ও জানেন নয়াদিল্লীর এখন জানা উচিত বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম জাতিতে পরিণত না হলে একজন শরাণার্থীও, অনন্ত একজন অমুসলমান কিম্বা রাজনীতি সচেতন মুসলমানও ফিরে যাবে না। তথাকথিত বিশ্ব সমাজ যতই বুঝান বা চাপ দিন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত্তিতে কোন ‘রাজনৈতিক সমাধান ইয়াহিয়া খান মেনে নেবেন কখনও তার কোন সম্ভাবনা নেই। এই ধরনের বুঝানো পড়ানো ও পীড়াপীড়ির ফল কি হয়েছে তা ইয়াহিয়া খান নিজেই তাঁর বহু প্রতীক্ষিত ১২ই অক্টোবরের বিবৃতিতে বিশ্ববাসীকে শুনিয়ে দিয়েছেন। অনুমান রাশিয়া এবং আমেরিকা উভয়েই রাজনৈতিক সমাধাণের প্রথম ধাপ হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেবার জন্য পাক প্রেসিডেন্টের ওপর চাপ দিচ্ছেন। তার উত্তরও ইয়াহিয়া খান দিয়েছেন। তিনি বলেছেন সামরিক ট্রাইব্যুনালের যে প্রহসনটি তিনি খাড়া করেছেন তা যদি শেখ মুজিবকে নির্দোষ না করে তাহলে তিনি একজন দেশদ্রোহীর সঙ্গে কথা বলতেও প্রস্তুত নন। যে মানুষটি অতি সম্প্রতি পাকিস্তানের নির্বাচনে এক বিস্ময়কর জয়ের গৌরব অর্জন করেছেন এবং সমগ্র পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে তাঁর দলকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এনে দিয়েছেন, জনমত যাচাই করে তার ভাগ্য নির্ণয় করা হবে- এ কথা বলতেও ইয়াহিয়া খানের মুখে আটকায়নি। রাজনৈতিক সমাধানের জন্য বৃহৎ শক্তিবর্গের এবং আমাদের প্রধানমন্ত্রীরও চেষ্টা চরিত্রের এই হচ্ছে নীট ফল। এই ‘রাজনৈতিক সমাধান বস্তুটিকেও ইচ্ছা করেই অস্পষ্ট রাখা হয়েছে- অবশ্য তার একটি বক্তব্য খুবই স্পষ্ট, সেটি হল অখন্ড পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে থেকে সমাধান। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তিলাভের জন্য আমেরিকাও সংগ্রাম করেছে, কিন্তু সে অনেক দিনের কথানিউইয়র্ক বন্দরে স্ট্যাচু অব লিবার্টি (স্বাধীনতার মর্মরমূর্তি) ছাড়া সেই উপনিবেশবাদ বিরোধী আদর্শের আজ আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। প্রকৃতপক্ষে আজ আমেরিকা নিজেই একটি বৃহৎ উপনিবেশিক শক্তি। অন্যদিকে রাশিয়া বরাবর ঔপনিবেশিকতা বিরোধী সমস্ত মুক্তি সংগ্রামে উচ্চকণ্ঠে তার পরিপূর্ণ সমর্থন জানিয়ে আসছে বটে কিন্তু তার তাঁবেদার রাষ্ট্রগুলোর ওপর তার দখল শিথিল করবার কোন ইচ্ছাই দেখাচ্ছে না : নিতান্ত ভদ্র ভাষাতেই এগুলো তাঁবেদার, আসলে এই রাষ্ট্রগুলো সেই পুরাতন ঔপনিবেশিরই মতন। এই দুই মহাশক্তি নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে বিশ্বের ভবিতব্যের মুঠি ধরে রয়েছে। এবং তা কোন নৈতিক ক্ষমতায় নয়, সংহারের ভীষণতম হাতিয়ার হাতে থাকার জোরে। বাংলাদেশের পক্ষে নিদারুণ বেদনার যে, পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যা সম্পর্কে এই দুই শক্তির দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যে-রুশ-ভারত চুক্তি সত্ত্বেও কোন মৌলিক তফাৎ নেই। নিজ নিজ জাতীয় স্বার্থ অনুসারে এই দুই দেশেই পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি রক্ষার জন্য উদ্বিগ্ন