পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/২৬১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

234 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ দ্বিতীয় খন্ড সকলেই জানেন যে, ১৯৫৩ সনে ওয়াশিংটনের পরামর্শে গোলাম মোহাম্মদ চক্র খাজা নাজিমুদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রিত্বের পদ হইতে অপসারণ করেন এবং বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসাইয়া দেন। ঐ গোলাম মোহাম্মদ-ইস্কান্দার মীর্জা চক্রই ১৯৫৪ সনে মার্কিনী রাষ্ট্রদূত হিলড্রেথের পরামর্শে পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে পদচ্যুত করে; ঐ গণবিরোধী চক্রই বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে সরাইয়া চৌধুরী মোহাম্মদ আলীকে প্রধানমন্ত্রিত্বের গদীতে বসায়। ঐ গণবিরোধী চক্রই সোহরাওয়াদী মন্ত্রিসভাকে পদচ্যুত করিয়া চুন্দ্রগড় মন্ত্রিসভা গঠন করে; ঐ গণবিরোধী চক্রই পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার পতন ঘটায়; ঐ গণবিরোধী চক্রই পূর্ব পাকিস্তানের আইন সভায় মারামারি বাধাইতে মন্ত্রিসভার পতন ঘটায়; ঐ গণবিরোধী চক্রই পূর্ব পাকিস্তানের আইন সভায় মারামারি বাধাইতে ও মরহুম শাহেদ আলীর হত্যার উস্কানি দেয়; এবং পরিশেষে সামরিক শাসন কায়েম করে। ইহা সত্য যে, কতিপয় রাজনৈতিক নেতা গদীর লোভে বা গদী রক্ষার জন্য ঐ গণবিরোধী চক্রের উস্কানিতে ও প্রলোভনের ফাঁদে পা দিয়াছিলেন। সেই রাজনৈতিক নেতাদের দেশবাসী তীব্র ভাবে নিন্দা করে। কিন্তু মন্ত্রিত্বের ঐসব ভাঙ্গাগড়ার প্রধান দায়িত্ব তাহাদের ছিল না। কিন্তু মন্ত্রিত্বের সব ভাঙ্গাগড়ার আসল হোতা ছিল দেশের কায়েমী স্বার্থবাদীদের মুখপাত্র । ঐ গোলাম মোহাম্মদ-ইস্কান্দার চক্র এবং মার্কিনী সাম্রাজ্যবাদীরা জনাব আইয়ুব খাঁ কি উহাদের ঐসব কুকর্মে তাঁহার সহযোগিতা অস্বীকার করতে পারেন? তিনি নিজেও কি ঐ সব কু-কর্মে উহাদের সাথে জড়িত ছিলেন না? যাহা হউক,১৯৫৩ সন হইতে পাকিস্তানে মন্ত্রিসভার বার বার পরির্বতনের আসল তথ্য ইহাই প্রমাণ করে যে, পার্লামেন্টারী শাসন ব্যবস্থার ফলে ঐ সব ঘটনা ঘটে নাই। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার পরিবর্তনগুলি শুধু ১৯৫৮ পার্লামেন্টে ভোটাভুটির ফলে সাধিত হয় নাই। ঐ সমস্ত পরিবর্তন ঘটিয়াছে পর্দার আড়ালে উপরতলার চক্রান্তের ফলে। ইহার জন্য পার্লামেন্টারী শাসন ব্যবস্থা দায়ী হইতে পারে না। বরং উপরতলার ঐ চক্রান্ত ভাঙ্গার এবং দেশে স্থিতিশীল সরকার প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ ছিল সাধারণ নির্বাচন করিয়া জনগণের ভোটে নির্বাচিত আইনসভার হাতে সার্বভৌম ক্ষমতা অর্পণ করা। নুন মন্ত্রিসভার আমলে দেশ সেই পথেই যাইতেছিল। কিন্তু, সামরিক শাসন জারি করিয়া জনাব আইয়ুব খাঁ-ই সে পথ রুদ্ধ করিয়াছেন। তিনিই দেশের সত্যিকারের স্থিতিশীল সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে দেন নাই। আজ যে স্থিতিশীল শাসনের বড়াই তিনি করিতেছেন, সেই স্থিতিশীলতার প্রকৃত অর্থ কি? যদি তিনি বলিতে চান যে, গত ছয় বৎসরে তাঁহার রাজত্বের কোন পরিবর্তন হয় নাই বলিয়া উহা স্থিতিশীল’, তাহা হইলে বলিতে হয় স্পেনের ফ্র্যাঙ্কোর এবং পর্তুগালের সালাজারের সরকার আজ দুনিয়াতে সবচাইতে স্থিতিশীল সরকার। কারণ গত প্রায় ৩০ বৎসরেও ফ্র্যাঙ্কোর এবং সালাজারের রাজত্বের পরিবর্তন হয় নাই। কিন্তু দুনিয়ার জনগণ ফ্র্যাঙ্কোর ও সালাজারের সরকারকে জঘন্য মানবতাবিরোধী নিরঙ্কুশ একনায়কত্ব বলিয়া নিন্দা করে ও ঘৃণা করে। জনাব আইয়ুব খাঁ’র স্থিতিশীল এবং প্রেসিডেন্সিয়াল শাসন ও নিরঙ্কুশ একনায়কত্বের শাসন ব্যতীত আর কিছুই নহে। জনগণের উপর হিংস্র দমন নীতির ষ্টীম রোলার চালাইয়া এবং জনগণকে ভোটের অধিকার, ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রভৃতি মৌলিক অধিকার হইতে বঞ্চিত করিয়া জনাব আইয়ুব খাঁ'র স্থিতিশীল এবং প্রেসিডেন্সিয়াল শাসন প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। এই স্থিতিশীলতা’ হইল মানুষের কবরের স্থিতিশীলতা” সামরিক শক্তির জোরে ক্ষমতা দখল করিয়া পরে জনগণকে সমস্ত অধিকার হইতে বঞ্চিত করিয়া গদীতে টিকিয়া থাকিলেই উহাকে স্থিতিশীল সরকার বলিয়া অভিহিত করা যায় না। স্থিতিশীল সরকারের আসল ভিত্তিই হইল দেশের জনগণের সমর্থন। যখন কোন দেশের জনগণ নিজেদের স্বাধীন ইচ্ছায় ও নিজেদের ভোটে কোন সরকার গঠন করে তখনই সে দেশের সরকার সত্যিকারের স্থিতিশীলতা লাভ করে।