পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/২৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

239 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ দ্বিতীয় খন্ড মন্ত্রিসভার মুখ্যমন্ত্রী জনাব ফজলুল হক তাঁহার (কালাহনের) সহিত এক সাক্ষাৎকারে বলিয়াছেন যে, তিনি পূর্ব পাকিস্তানেরও পশ্চিম বঙ্গের একত্রীকরণ কামনা করেন। সাম্রাজ্যবাদের ভাড়াটিয়া কালহানের পরিবেশিত ঐ মিথ্যা খবরকে সম্বল করিয়া কেন্দ্রীয় শাসকচক্র যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে গাদ্দারের মন্ত্রিসভা বলিয়া উহার বিরুদ্ধে সারা দেশব্যাপী এক বিরাট প্রচার অভিযান শুরু করিল। ইহার সঙ্গে সঙ্গেই সংঘটিত হইল আদমজী মিলে বাঙ্গালী ও অবাঙ্গালী শ্রমিকদের ভিতর রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা। ঐ দাঙ্গার সহিত জড়িত কয়েকটি মামলায় ইহা প্রমাণিত হইয়াছিল যে, আদমজী মিলের কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী সুপরিকল্পিতভাবে ঐ দাঙ্গা বাধাইয়াছিল। করাচীর নির্দেশেই ঐ দাঙ্গা সংঘটিত হইয়াছিল। ঐ দাঙ্গার অব্যবহিত পরেই আইন ও শৃঙ্খলার অজুহাতে গণনির্বাচিত যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে কেন্দ্রের নির্দেশে পদচ্যুত করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানে জারি হয় ৯২(ক) ধারার সন্ত্রাস এবং পূর্ব পাকিস্তান শাসনের একচ্ছত্র অধিকার দেওয়া হয় ইস্কান্দার মীর্জার হাতে। গোলাম মোহাম্মদ তখন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল, জনাব আইয়ুব খাঁ তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অধিনায়ক এবং মার্কিনীদের পরম সুহৃদ, বগুড়ার মোহাম্মদ আলী তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। এইসব উজ্জ্বল রত্বের সমাবেশের পটভূমিকাতেই গণবিরোধীদের আক্রমণে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকেও ভাঙ্গা হয়। ইহাই যুক্তফ্রন্ট ভাঙ্গনের প্রথম পর্ব। উল্লেখযোগ্য যে, যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার পদচ্যুতির কয়েকদিন পরেই প্রথম পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বিভেদের ষড়যন্ত্রের জাল “যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার অপসারণেও কেন্দ্রীয় শাসকবর্গের সমস্যার সমাধান হইল না। মন্ত্রিসভা গদীতে না থাকিলেও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অটুট সমর্থন রহিয়া গেলো যুক্তফ্রন্টের পিছনে। এখানে প্রশাসনিক বিভাগ কেন্দ্রীয় শাসকবর্গের হাতে থাকিলেও জনগণের ভিতর তাহদের কোন সমর্থনই ছিল না। ইহাই ছিল লোকের বাসভূমি পূর্ব পাকিস্তানকে এরূপভাবে শাসন করা যায় না। তাই যুক্তফ্রন্টের বিভিন্ন অঙ্গদলের নেতাদের মন্ত্রিত্বের গদী দ্বারা প্রলুব্ধ করিয়া তাঁহাদের হাত করার জন্য এক গভীর ষড়যন্ত্র শুরু হইল। উপরতলার ষড়যন্ত্রের উপযোগী ক্ষেত্রও তখন বিরাজ করিতেছিল। পূর্ব পাকিস্তান তখন ব্যাপক সন্ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত। হাজার হাজার গণতান্ত্রিক কর্মী ও নেতা তখন কারারুদ্ধ, সভাসমিতি করার অধিকার হইতে জনগণ বঞ্চিত। রাজনৈতিক দলগুলি স্বাধীনভাবে কাজ করিতে পারিতেছিল না। এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে গোলাম মোহম্মদ-ইস্কান্দার চক্রের দূতগণ দেশে ও বিদেশে যুক্তফ্রন্ট নেতাদের দুয়ারে ধর্না দিয়া আলাদা আলাদাভাবে তাঁহাদেরকে মন্ত্রিতু গ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানাইতে লাগিল। যে নেতাদের একদা ‘গাদার’ বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছিল, সেই নেতাদের নিকট শাসকবর্গের গোপন দূত আনাগোনা করিতে লাগিল। “যুক্তফ্রন্টের অনেক নেতা তখনই ঐ ফাঁদে পা দিয়াছিল। মন্ত্রিত্বের গদীর জন্য তাহারা অনেকে গোলাম মোহাম্মদ-ইস্কান্দার চক্রের সাথে আপোস করিয়াছিলেন। তাঁহাদের ঐ দুর্বলতা, ঐ নীতিবিগর্হিত কাজ হাজারবার নিন্দনীয়। কিন্তু ইহা বাস্তব সত্য যে, মার্কিনী সাম্রাজ্যবাদীদের পরামর্শে ও সাহায্যে এবং দেশীয় কায়েমী স্বার্থবাদীদের স্বার্থে গোলাম মোহাম্মদ-ইস্কান্দার চক্র শুধু পশুশক্তিবলে গণনির্বাচিত যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে পদচ্যুত করিয়া যে ভাঙ্গনের পালা শুরু করিয়াছিল এবং যুক্তফ্রন্টের ঐক্য চুরমার করিয়া দেওয়ার জন্য ঐ গণবিরোধী চক্র ষড়যন্ত্রের যে জাল বিস্তার করিয়াছিল এবং যুক্তফ্রন্টের অনেক নেতা উহার শিকারে পরিণত হইয়াছিল। যুক্তফ্রন্ট ভাঙ্গনের প্রধান দায়িত্ব ছিল মার্কিনী সাম্রাজ্যবাদের অনুগত এবং দেশের কায়েমী স্বার্থবাদীদের মুখপাত্র ঐ গণবিরোধী চক্রের। জনাব আইয়ুব খাঁ আজ অস্বীকার করিতে পরিবেন না যে, তিনিও ঐ চক্রের অন্যতম মধ্যমণিরুপে কাজ করিয়াছিলেন। যুক্তফ্রন্ট ভাঙ্গনের কাজে তাহার হাত ও কলংকিত।