পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/২৮৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

260 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ দ্বিতীয় খন্ড নিয়ন্ত্রন করিয়া থাকে। ইক্ষুর উপর তাহারা তাহদের নিজেদের নির্ধারিত মূল্য চাঁপাইয়া দেয়। বেশী মূল্যে তাহারা ইক্ষু ক্রয় করিতে অস্বীকার করিয়া ইক্ষুচাষীদের বাধ্য করে কম মূল্যে তাহদের পণ্য বিক্রয় করিতে। ইক্ষুচাষীকে বাধ্য করিবার জন্য তাহারা কৃষকের পণ্য বিক্রয়ের উপর নানাবিধ বাধানিষেধ আরোপ করে। ইক্ষুর পরিবর্তে তাহারা মিলে কাঁচামাল হিসেবে গুড় ব্যবহার করে। এইভাবে বিভিন্ন পন্থায় তাহারা ইক্ষুচাষীদের অনাহারে এবং করুণার পাত্র করিয়া রাখে।এই অবস্থায় মিল মালিকরা যে শর্ত আরোপ করে তাহা মানিয়া লইয়া নতি স্বীকার করা ভিন্ন ইক্ষুচাষীদের আর কোন গত্যন্তর থাকে না। ইক্ষুচাষীদের এই অবস্থার প্রতিকার বিধানের ব্যাপারে কাহারও মাথাব্যথা আছে বলিয়া মনে হয় না। ডেপুটি কমিশনারদের ন্যায় সরকারী কর্মচারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপরিণত বুদ্ধি সম্পন্ন ও অযোগ্য হইয়া থাকে এবং তাহারা প্রায়শঃই মিল মালিকদের লোভের শিকারে পরিণত হইয়া তাহদের প্রতি সমর্থন প্রদান করিয়া থাকে। পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতিদিনই কৃষকদের অবস্থার অবনতি ঘটিতেছে। জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততায় বিনষ্ট হাজার হাজার একর জমি চাষের অনুপযোগী হইয়া পড়ায় পশ্চিম পাকিস্তানের বিশেষ করিয়া পাঞ্জাবের বিভিন্ন জেলার কৃষকরা এক ভয়াবহ ভবিষ্যতের সম্মুখীন হইয়াছে। অসংখ্য কৃষক আজ এই দুর্যোগময় ভবিষ্যতের মুখোমুখি হইয়াছে। ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাইতেছে। পূর্ব পাকিস্তানে বন্যা ও অনাবৃষ্টি কৃষকদের একইরূপ অভিশাপের মত কাজ করে। ইহারই ফলশ্রুতি দুইটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে দেখিতে পাওয়া যাইবে। প্রথম ক্ষেত্রে, কৃষি উৎপাদন বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছে। দ্বিতীয়তঃ কৃষক অধিকহারে ভূমিহীন ও কপদহীন হওয়ার দরুন শিল্পোন্নয়নের সাথে সাথে আভ্যন্তরীণ, বাজার সম্প্রাসরণের পরিবর্তে দ্রুত সংকুচিত হইতেছে- যাহার ফলে গুরুতর জাতীয় সংকটের সৃষ্টি হইতেছে। শ্রমিকদের অবস্থা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অগ্নিমূল্যের ফলে শ্রমজীবী জনসাধারণের জীবনধারণ ক্রমশঃ কষ্টসাধ্য হইয়া উঠিতেছে। কল-কারখানার মালিকগণ স্বাধীনভাবে ও নির্ভয়ে শ্রমিকদের শোষণ করিয়া প্রচুর মুনাফা অর্জন করে। কিন্তু শ্রমিকগণ কয়েক বছর আগে যে বেতন পাইতেন, এখনও কাৰ্য্যতঃ সেই বেতনই পাইতেছেন। ধর্মঘট ও যৌথ দরকষাকষির মৌলিক অধিকার হইতে বঞ্চিত করিয়া শ্রমিকদিগকে মালিকেরা খেয়ালখুশীর তাঁবেদার এককক্ষমতাহীন জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা হইয়াছে। তাঁহাদের দুঃখ-দুর্দশ ক্রমাগতবৃদ্ধি পাইয়া চলিয়াছে, অথচ তাঁহাদের বেতনের হারের কোন পরিবর্তন ঘটে নাই, তদুপরি তাঁহাদের অধিকারসমূহকে খর্ব ও পদদলিত করা হইয়াছে। বিড়ি শ্রমিকগণ বিশেষভাবে দুর্দশাগ্রস্ত। টেন্তু পাতার ব্যবহার ও আমদানী নিষিদ্ধকরণের ফলে তাঁহার বেকারত্ব ও অনাহারের সম্মুখীন হইয়াছে। ছাত্রদের অবস্থা শিক্ষা ক্রমবর্ধমান হারে ব্যবসায় পরিণত হইতেছে। স্কুল- কলেজের বেতন প্রদান করা অধিকাংশ পিতামাতার ক্ষমতার বাহিরে চলিয়া গিয়াছে। অধিকহারে স্কুল, কারিগরি ও মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের ব্যাপারে দৃষ্টি না দেওয়ার ফলে অধিকাংশ পিতা-মাতা তাহদের সন্তান-সন্ততিকে বর্তমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে ভর্তি করাতে পারেন না। পাঠ্য পুস্তকের ব্যবসায় চরম জালিয়াতি চলিতেছে। প্রতি বছর পাঠ্য-পুস্তক বদল করার ফলে পুরনো বই আর ব্যবহার করা যায় না। বহু অর্ডিন্যান্স ও অন্যান্য নিয়মকানুনের মাধ্যমে ছাত্রদের স্বাধীন ও অবাধ বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করিয়া এবং দেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে তাহদের ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনের সুযোগ হইতে বঞ্চিত করিয়া তাহাদিগকে বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা করা হইয়াছে। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুলশিক্ষকগণ এক বিশেষ দুদিনের মধ্যে কালযাপন করিতেছেন, তাহদের কার্যকলাপের উপর গোপন খবর রাখা হইতেছে ও বুদ্ধিবৃত্তির স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা হইতেছে।