পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/৩০৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

280 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ দ্বিতীয় খন্ড নবজীবনের স্রোত একদিকে যখন একচেটিয়া পুঁজিবাদ ও সামন্তস্বার্থের রক্ষক সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী আমলাতান্ত্রিক স্বৈরশাহীর শাসন, শোষণ ও অত্যাচার আজ চরমে পৌঁছায়াছে, অপরদিকে তখন নিপীড়িত, অত্যাচারিত জনতার বুকের পুঞ্জীভূত বিক্ষোভ আজ শান্তিপূর্ণ হরতালের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে। পাকিস্তানের জীবনেতিহাসে এমন হরতাল আর দেখা যায় নাই। পিকেটিংয়ের প্রয়োজন হয় নাই, স্বেচ্ছাসেবকের কথা কেউ চিন্তাও করে নাই- তবুও ৭ই জুন ভোরবেলা দেখা গেল লক্ষ কোটি জনতা নিজেরাই স্বেচ্ছাসেবক, চোখেমুখে তাঁদের দৃপ্ত শপথ, আত্মশক্তিতে গভীর আস্থা-কোনও ভ্ৰকুটি, কোনও চন্ডনীতিই তাঁহাদিগকে টলাইতে পরিবে না- প্রত্যেকেই সৈনিক- মঞ্জিলে পৌছাইতে হইবে। কাপিয়া উঠিল জুলুমশাহীর বুক, টলিয়া উঠিল এতদিনের পাকাপোক্ত আসন- আর গর্জিয়া উঠিল পুলিশের বুলেট। শহীদানের রক্তে বিভিন্ন রাজপথ লাল হইয়া উঠিল। শোকের ছায়া নামিয়া আসিল সমস্ত শহরে, পথে-প্রান্তরে। তবে মাতম নয়-বজ্ৰকঠোর শপথ-শহীদানের রক্তের ডাক এ দেশের জনতার রক্তেও আগুন ধরাইয়া দিল। শহীদানের রক্তপাত বৃথা যায় না। সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী এই জালিম সরকার সাম্রাজ্যবাদেরই সহযোগিতায় ১৯৫৮ সনে সামরিক শাসন জারির মারফত দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা পুরোপুরি কজা করিয়া নিয়াছে। আপামর জনসাধারণের সুখী-সুন্দর স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনের আশা-আকাঙ্খা মাটিচাপা দিয়াছে। বাকস্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ মানুষের সকল মৌলিক অধিকার ছিনাইয়া লইয়াছে। একনায়কত্ব বনাম সুখী সমৃদ্ধশালী দেশ গঠন শোষকশ্রেণী কর্তৃক একচেটিয়া মুনাফা লুণ্ঠন ও শোষণ ব্যবস্থাকে স্থায়ীভাবে চাপাইয়া দেওয়ার গরজেই সুপরিকল্পিত উপায়ে একনায়কত্বের প্রতিষ্ঠা হইয়াছে। পাকিস্তান কায়েমের পর পরস্পরবিরোধী দুইটি স্বার্থের সংঘাত শুরু হয়। প্রতিটি নাগরিকের খেয়ে-পরে সুখে শাস্তিতে বাঁচার সুবন্দোবস্ত করিতে হইলে- (১) শোষণ ব্যবস্থা খতম করা প্রাথমিক কাজ এবং (২) শিল্প-কৃষির দ্রুত উন্নতির জন্য সকল বিদেশী পুঁজি, ব্যাঙ্ক, পাট, তুলা ইত্যাদি ব্যবসা জাতীয়করণ, (৩) সামন্তবাদকে উচ্ছেদ করিয়া প্রকৃত চাষীর হাতে জমি প্রদান- জাতীয় উন্নতির জন্য এই ত্ৰিবিধ কর্মধারা সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও একচেটিয়া পুঁজিবাদী শোষণের ভিত্তিমূলকেই উৎপাটিত করিবে। দেশী-বিদেশী শোষকচক্র এই কর্মপন্থাকে বানচাল করিতে চায়। দ্বিতীয়তঃ কৃষি- শিল্পের দ্রুত উন্নতির সাধনের জন্য সাম্রাজ্যবাদীদের আওতামুক্ত স্বাধীন অর্থনীতির বুনিয়াদ অপরিহার্য শর্ত। এই পথে প্রথম পদক্ষেপ হইতেছে দেশে ইস্পাত, লোহা ও যন্ত্রশিল্প গড়িয়া তোলা। বিগত দশ বৎসর যাবৎ পাকিস্তানে একটি ইস্পাত কারখানা স্থাপন করিয়া দিবার প্রস্তাব সোভিয়েত ইউনিয়ন দিয়া আসিতেছে। কিন্তু এই দেশে ইস্পাত তৈরী হইলে পাকিস্তানে মার্কিনীদের শত শত কোটি টাকার লোহার সরঞ্জাম বিক্রয়ের বাজার নষ্ট হইবে। এইজন্য মার্কিনীদের নির্দেশে ও দেশীয় বড় ধনিকদের কারসাজিতে পাকিস্তানে ইস্পাত কারখানা স্থাপন করা হইতেছে না। কৃষিপ্রধান দেশে পরিণত করিয়া রাখিয়াছে। অথচ কৃষিপ্রধান পাকিস্তানে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার খাদ্যদ্রব্যও বিদেশ হইতে আমদানী করিতে হয়। এই অতি মুনাফাখোরদের স্বার্থে দেশে খাদ্য, বস্ত্র ঔষধপত্র ইত্যাদির দাম সাধারণ লোকের ক্রয়ক্ষমতার নাগালের বাহিরে চলিয়া গিয়াছে। তদুপরি, খাজনা, ট্যাক্স দিন দিন বাড়িতেছে। আগামী বৎসরের কেন্দ্রীয় বাজেটে আরো ৩৭ কোটি টাকা নতুন ট্যাক্স বসানো হইয়াছে। টেন্ডুপাতা ব্যবহার নিষিদ্ধ করিয়া লক্ষ লক্ষ বিড়ি শ্রমিককে ভাতে মারার যোগাড় হইয়াছে। ধর্মঘটের অপরাধে শত শত রেল শ্রমিক চাকুরী হারাইয়াছেন।