পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/৫৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

529 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ দ্বিতীয় খন্ড বিস্তারিতভাবে লেখার দায়িত্ব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের উপর ছাড়িয়া দিতেছেন। এই দিক হইতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের স্বৈরতান্ত্রিক পদ্ধতি পূর্বের মত বহাল থাকিতেছে। অন্যদিকে ছাত্রসমাজ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত শিক্ষানীতিকে চূড়ান্তভাবে ঘোষণা করা হইয়াছে। তাই স্বাধীনতার পর হইতেই বৈজ্ঞানিক গণতান্ত্রিক ধর্মনিরেপক্ষ, সার্বজনীন ও সহজলভ্য শিক্ষা হইতে ছাত্রসমাজ বঞ্চিত হইতেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য বিভাগ, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, আইইআর, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজ সমাজকল্যাণ কলেজ, জগন্নাথ কলেজ, পলিটেকনিক কলেজ, কৃষি কলেজ, এন.ডি.টি, আই গ্রাফিক আর্ট ইন্সটিটিউট, টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট, প্যারা মেডিক্যাল প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছাত্রীদের দাবী আজও মানিয়া লওয়া হইতেছে না। হলে এবং হোষ্টেলে খাদ্যের নিম্নমান ও সিট সমস্যা চরম আকার ধারণ করিয়াছে। ছাত্রনেতা হায়দার আলী, মাহবুবউল্লাহ, বিধান, নির্মল, হিমাংশু বণিক, শুকদেব ঘোষ ও জননেতা মণি সিং, অজয় রায়, হাবিবুর রহমান, দেবেন সিকদার, শহীদুল্লাহ চৌধুরীসহ অসংখ্য দেশপ্রেমিক ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে কারারুদ্ধ, মামলা, গ্রেফতারী পরোয়ানা প্রভৃতির মাধ্যমে প্রচন্ড দমননীতির শিকারে পরিণত করা হইয়াছে। দ্বিতীয়বারের জন্য সামরিক সরকারের শাসন কায়েম হইবার পর হইতেই আমরা দেশের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির ঐক্য বজায় রাখার আবেদন জানাইয়াছিলাম। বিশেষতঃ গত ১লা জানুয়ারী হইতে রাজনৈতিক কার্যকলাপের সীমিত অধিকার ফিরিয়া পাওয়ার পর গণতান্ত্রিক শক্তি ও রাজনৈতিক দলগুলির ঐক্যজোট কায়েমের অতীব গুরুত্ব আমরা ব্যাখ্যা করিয়াছিলাম কিন্তু সকলেই জানেন, আমাদের এই আবেদনে কেহ কেহ সাড়া না দিয়া বরং গণতান্ত্রিক শক্তি ও দলগুলির মধ্যে বিভেদ ও অনৈক্য সৃষ্টি করেন। খুবই দুখঃজনক যে ১১-দফা উত্থাপনকারী ছাত্রসমাজের মধ্যেও বিভেদ তীব্র হইয়া ওঠে। অপরদিকে দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীগুলি তাহাদের প্রতিক্রিয়াশীল লক্ষ্য অর্জনের জন্য গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে যেন জাতীয় পরিষদ সার্বভৌম হইতে না পারে। উপরন্তু ইহা জানা আছে যে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী নীতিগতভাবেই গণতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসন ও শ্রমিক কৃষকের স্বার্থের বিরুদ্ধে। এই পটভূমিতেই প্রেসিডেন্ট যে নির্বাচনী আইনগত কাঠামো ঘোষণা করিয়াছেন উহা দেশের ব্যাপক জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়াছে। এক বৎসর আগে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম এবং গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যের জোরে যতগুলি দাবী আদায় করা সম্ভব হইয়াছিল এবং সার্বভৌম জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের যে প্রতিশ্রুতি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দিতে বাধ্য হইয়াছিলেন আজ গণতান্ত্রিক শক্তির বিভেদের ফলেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এই প্রতিশ্রুতি অবজ্ঞা করিতে পারিতেছেন। শাসকগোষ্ঠী আজ কৌশলে বীর শহীদদের রক্ত ও জীবনের মূল্য অর্থহীন করিতে প্রয়াস পাইতেছে। কিন্তু পূর্ব বাংলা তথা সারা পাকিস্তানের সংগ্রামী ছাত্র-সমাজ ও জনগণ শাসকগোষ্ঠীর এই অপচেষ্টা ব্যর্থ করিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রহিয়াছে। দেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলি ও নেতৃবৃন্দ এবং ছাত্রসমাজসহ কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী সকলের প্রতি আমাদের আবেদন যে সময় থাকিতে ঐক্যবদ্ধ হউন ও ১১-দফা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য লইয়া সার্বভৌম জাতীয় পরিষদ কায়েমের দাবীতে ঐক্যবদ্ধ প্রতিষ্ঠার পথে আগাইয়া আসুন দাবী তুলুনপ্রতিক্রিয়াশীল আইনগত কাঠামো সংশোধন কর। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এবং ইতিহাস হইতে এই শিক্ষা গ্রহণ করিয়াছি যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের পথে আগাইয়া আসিলে বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত। কিন্তু বিভেদ আনবে সর্বনাশ। সরকারের কাছে দাবীঃ দেশের শাসনতান্ত্রিক সমস্যা এভাবে সমাধান করার জন্য নির্বাচনী আইনগত কাঠামো সংশোধন করে সার্বভৌম জাতীয় পরিষদ কায়েমের পথ প্রশস্ত করুন। অন্যথায় দেশের রাজনৈতিক স্থিতি সুদর পরাহত হইবে।