পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/৫৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

555 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ দ্বিতীয় খন্ড সমাজ জীবনের এই মহাসংকটই পূর্ব বাংলাকে আজ অগ্নিগর্ভ করিয়া তুলিয়াছে- যাহার সার্থক বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়াছিল ১৯৬৮-৬৯ সালের প্রচন্ড গণঅভু্যখানে। আর এই গণঅভু্যত্থান সমগ্র আন্দোলনকে উন্নীত করিয়াছে এক নতুন বিপ্লবী স্তরে। যেখানে মানুষ শান্তিপূর্ণ পথের সকল মোহকে ত্যাগ করিয়া তুলিয়াছে বিপ্লবী শক্তি প্রয়োগের পতাকাকে। জনতার আক্রমণে পর্যুদস্ত শাসকগোষ্ঠী সেদিন মরিয়া হইয়া শেষ অস্ত্র নিক্ষেপ করে। চাপাইয়া দেয় সামরিক শাসনের জগদ্দল পাথর। কিন্তু গণ-আন্দোলনের তীব্রতা ব্যাহত হইলেও, বিপ্লবী অবস্থা আজও বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয় নাই। জনতার বিপ্লবী মেজাজ আজও বিদ্যমান। আজও এই দেশের, বীর জনতা সংগ্রামের উত্তাল তরঙ্গাঘাতে শাসকগোষ্ঠীকে প্রতি মূহুর্তে নাস্তানুবাদ বানাইয়া ছাড়িতেছে। এই সেদিনও খুলনা জেলার বালি ও সিমেন্ট জেলার হাওর করাইয়ের বিপ্লবী কৃষক-জনতা জোতদার মহাজনের বিরুদ্ধে যে মহান লড়াইয়ের নজির স্থাপন করিয়াছে, খুলনার ও ঢাকার শ্যামপুর পোস্তগোলায় শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বীর শ্রমিক শ্রেণী যে দুধর্ষ আক্রমণ চালাইয়াছে, নিজের রক্ত ও শত্রর রক্তে তাহারা যেভাবে অবগাহন করিয়াছে, তাহাতে জনতার বিপ্লবী চেতনা নির্ভুলভাবে প্রমাণিত হইয়াছে। দিকে দিকে আজ তাহারা প্রজ্জ্বলিত করিয়াছে প্রতিরোধ আর প্রতি আক্রমণের বহ্নিশিখা শুরু করিয়াছে শ্রেণী সংঘর্ষের সশস্ত্র বিপ্লবী প্রক্রিয়া, জনযুদ্ধের মহান পথে শোষক শ্রেণীর বলপূর্বক উচ্ছেদে যাহার মহান পরিসমাপ্তি। ভীতসন্ত্রস্ত শাসকগোষ্ঠীও আজ তাই কেবল পাশবিক নিপীড়ন যথেষ্ট নয় বুঝিয়া, পাশাপাশি তুলিয়া ধরিয়াছে ঝুটা নির্বাচনের টােপ। ভোট ও মন্ত্রীত্বের লড়াইয়ের মধ্যে নিক্ষেপ করিয়া শ্রমিক কৃষক মেহনতী জনতার বিপ্লবী চেতনাকে ভোঁতা করিয়া দেওয়া ও আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করিয়া শোষণের ইমারতকে রক্ষা করাই তাহাদের আসল উদ্দেশ্য। আর শাসক শ্রেণীর এই নির্বাচনী ষড়যন্ত্রে শামিল হইয়াছে জনতার মধ্যে লুকিয়ে থাকা শোষক শ্রেণীর রঙ-বেরঙের দালালরা-তথাকথিত “জনদরদী” রাজনৈতিক দলসমূহ ও তাহদের নেতৃবৃন্দ। বাঙ্গালী জাতীয়তা, শ্রমিক কৃষকের মুক্তি, এমনকি “বিপ্লবী” বলির আড়ালে জনতাকে তাহারা ক্ষমতা ভাগাভাগির বাহন হিসাবে ব্যবহার করিতে চাহিতেছে। বন্ধুগণ, আজ এমন একটি রাজনৈতিক পটভূমিতে আপনারা উপস্থিত হইয়াছেন আপনাদের দাবী আদায়ের এবং শোষণ হইতে মুক্তি পাইবার অনেক আশা বুকে লইয়া। কিন্তু আজ বুঝিতে হইবে সত্যিকার মুক্তির পথ কোনটি, দাবী পূরণের হইবে কোন পথে। ভোটের মাধ্যমে? জনসভার মা্যধমে? শহরে আসিয়া এমন শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও গণমিছিল করিয়া? স্মারকলিপি প্রদান বা শাসকগোষ্ঠীর কাছে দেন দরবার করিয়া তাহাদের করুণা দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া? না। এই পথ ধসে পড়া শোষণের ইমারতকে চূর্ণবিচূর্ণ করে না, তাহার উপর সংস্কারের প্রলেপ লাগাইয়া নতুন মোহই সৃষ্টি করলে কেবল। আজ একটি মাত্র পথই খোলা আছে। সেই পথ সশস্ত্র বিপ্লবের পথ। শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক মেহনতী জনতার বিপ্লবী লড়াইয়ের পথ। আর এই লড়াই শুরু হইবে গ্রামে কৃষকের মুক্তির পতাকাকে দৃঢ়ভাবে আকড়াইয়া ধরিয়া। শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে গ্রাম এলাকায় কৃষকের শ্রেণী সংগ্রামকে বিপ্লবী জন-যুদ্ধে পরিণত করিয়া, সেখানে কৃষকের রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করিয়া, সশস্ত্র ঘাটি এলাকা তৈরী করিয়া শহরসমূহ অবরোধ এবং সর্বশেষ সারা পূর্ব বাংলার বুক হইতে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও আমলা মুৎসুদি পুঁজির এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা উচ্ছেদ করিয়া জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েমের মাধ্যমেই আসিবে পূর্ব বাংলার শ্রমিক-কৃষক মেহনতী জনতার মুক্তি। আর কৃষি বিপ্লবের এই প্রক্রিয়াকে সম্পন্ন করিবার জন্য তাহারই পাশাপাশি শহরে গড়িয়া তুলিতে হইবে শ্রমিকছাত্র-মেহনতী জনতার বিপ্লবী গণঅভু্যত্থান-আঘাতের পর আঘাতের মাধ্যমে যাহা শক্ৰশক্তিকে ব্যতিব্যস্ত রাখিবে বিপর্যস্ত করিবে। সমবেত কৃষক-শ্রমিক-মেহনতী জনতা, পূর্ব বাংলার বুক হইতে শোষণের অবসানের এই বিপ্লবী পথে আগাইয়া আসিবার জন্য আপনাদের আমরা আহবান জানাই। শান্তিপূর্ণ পথ, নিয়মতান্ত্রিকতার নিজীব পথকে