পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/৬১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

586 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ দ্বিতীয় খন্ড ঘূর্ণিঝড়ে পূর্ব পাকিস্তানের আটটি জেলার ঘর-বাড়ী, গাছ-পালা নির্ণয়াতীতভাবে ধ্বংস হইয়া গিয়াছে। আর সর্বশেষে দক্ষিণাঞ্চলের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছাস যে ধ্বংসলীলা ও প্রাণহানি সংঘটিত করিয়াছে এবং বন্যা ও ঘূর্ণিবাত্যার পর পুনঃ পুনঃ কলেরা-মহামারীতে আক্রান্ত হইয়া সহস্ৰ সহস্ৰ লোক অকালে প্রাণ হারাইয়াছে ও হরাইতেছে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকবর্গ, ক্ষমতালোভী নেতৃবর্গ আর উদাসীন শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিকবর্গকে তাহা নাড়া না দিলেও বিশ্বের তিনশত কোটি মানুষকে চঞ্চল করিয়া তুলিয়াছে। সরকার বরাবরের মত এই ধ্বংসলীলা ধামাচাপা দিবার প্রাণপণ চেষ্টা করিয়া গেলেও শেষ পর্যন্ত সত্যের বিজয় হইয়াছে। আমি ভাষায় প্রকাশ করিতে পারিনা যে আমাদের এহেন দুদিনে সরকার কি ধৃষ্টতা প্রদর্শন করিয়াছে। মানুষের হৃদয় নিঃসৃত ভালবাসা আর প্রজ্ঞা-প্রসূত বিবেচনার সম্মুখে প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিছুই নহে কিন্তু এই দুইটিরই অভাব আমরা মর্মে মর্মে অনুভব করিয়াছি। সরকার ও পশ্চিম পাকিস্তানীদের নিকট হইতে সেই ভালবাসা ও বিবেচনা পূর্ব পাকিস্তান পায় নাই বলিয়াই যেন প্রাকৃতিক দুর্যোগটি শতগুণ আঘাত হানিয়াছে। ইহার নতিজা সরকারকে ভোগ করিতেই হইবে। একজন মন্ত্রী মারা গেলে বেতার, টেলিভিশন ও অন্যান্য সরকারী প্রচারযন্ত্র কিভাবে মাতম শুরু করে তাহা আমাদের ভালোভাবেই জানা আছে। আর পশ্চিম পাকিস্তানী সরকার নিয়ন্ত্রিত বেতার টেলিভিশন ১২ লক্ষাধিক লোকের প্রাণহানিতে কিরূপ বিশ্বাসঘাতকতা ও ক্ষমাহীন ধৃষ্টতার পরিচয় দিয়াছে তাহা আজ সাতকোটি বাঙালীকে ভাবিয়া দেখিতে হইবে। লন্ডন, পিকিং, ওয়াশিংটন, তেহরান, আম্মান, সিডনি, টোকিও ও কলিকাতার বেতার যখন বিশ্ববাসীর নিকট সর্বনাশা জলোচ্ছাসের বিশদ বিবরণ তুলিয়া ধরিয়াছে, সাহায্য ও সামগ্ৰী পাঠানোর আবেদন জানাইতেছে, তখনও পাকিস্তানের বেতার, টিভি, বিশ্বাসঘাতক ও চরম মিথ্যাবাদীর ভূমিকা পালন করিতেছে; তখন তাহদের আহলাদমাখা অনুষ্ঠানের কমতি হয় নাই; বারলক্ষাধিক রুহের মাগফেরাত কামনা করা হয় নাই। লক্ষ লক্ষ লাশের দাফন কাফনের কর্তব্যের কথা স্বীকার করা হয় নাই। এর চেয়ে আফসোসের বিষয় আর কি হইতে পারে? আজ তাই আমাদের সম্মুখে কর্মসূচী পরিষ্কার হইয়া উঠিয়াছে। সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজের বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করিয়াছি। অনেক ত্যাগ স্বীকার করিয়াছি, অনেক কোরবান দিয়াছি। আজ আমাদের হাতে যাহাই অবশিষ্ট আছে সবকিছুই উৎসর্গ করিয়া সংগ্রামে ঝাঁপাইয়া পড়িতে হইবে। এই সংগ্রাম ভাষণ বিবৃতি নয় - প্রত্যক্ষ মোকাবেলা। এই মোকাবেলা আপোষ নিস্পত্তিকল্পে চাপ সৃষ্টি করার সংগ্রাম নয়- পূর্ব পাকিস্তানের সাত কোটি শোষিত নির্যাতিত মানুষের মুক্তির সংগ্রাম। দলমত নির্বিশেষে আজ সবাই আসুন, আমরা এক ও অভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করি। এবং ইহারই পরিপ্রেক্ষিতে মিছিল ও জনসভার আয়োজন করুন। তাই মিছিল ও জনসভা অনুষ্ঠান করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের নিকট জরুরী আবেদন করিতেছি। এইদিন আপনারা আওয়াজ তুলুনঃ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে এবং আমাদের আজাদী রক্ষা করিতে আমরা সর্বস্ব কোরবান দিতে সদা প্রস্তত। সেই সাথে আপনার বজ্ৰকণ্ঠে আওয়াজ তুলুনঃ আমরা স্বাবলম্বী, আত্ম-নির্ভরশীল এবং শৃঙ্খলমুক্ত হইতে চাই। আমরা বিশ্বাসঘাতক আমলাদের শায়েস্তা করিতে চাই। আমি বিশ্বাস করি মানবতার নামে আজাদীর লড়াইয়ে আমাদের সাফল্য অনিবার্য। সকল প্রকার বাধাবিপত্তি ও ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করিয়া আমরা ঈপ্সিত লক্ষ্য পৌঁছাব আশা করি বিশ্ববাসীরও ইহাই বিশ্বাস। কিন্তু এই প্রসঙ্গে আমি একটি হুশিয়ারীও উচ্চারণ করিতে চাই- আমাদের দুর্যোগ ও দুর্দিনকে সম্বল করিয়া যাহারা আন্তর্জাতিক রাজনীতির কোন চাল চালাইতে চায় তাহাদিগকে আমরা বরদাস্ত করিব না। আমাদের প্রয়োজনে যাহারা সাহায্য লইয়া আগাইয়া আসিতেছে তাহাদিগকে আন্তরিক মোবারকবাদ জানাই; কিন্তু সেবার নামে কেহ যদি ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে আমাদিগকে আটকাইতে চায় তবে তাহাকেও তল্পীতলপাসহ আমরা তাড়াইতে বাধ্য হইব।