পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/৬২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

600 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ দ্বিতীয় খন্ড এদিক থেকে বিচার করলেও দেখা যায়, মানব সৃষ্টির আদিকাল থেকে, পাক-ভারতের লোকেরা এবং বিশেষ করে বাংলাভাষীরা একত্রে বসবাস করে আসছে। আদমের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে, পাক-ভারতে আবির্ভূত অসংখ্য নবীর শিক্ষানুযায়ী আদিযুগে অন্যান্য ধর্মের ন্যায় হিন্দু ধর্ম ও একটি একেশ্বরবাদী এবং সাম্যবাদী ধর্ম ছিল। কিন্তু হিন্দু রাজা-মহারাজা ও সামন্তবর্গ তাদের সৃষ্ট কায়েমী স্বার্থকে রক্ষার জন্য হিন্দু ধর্মেও পৌত্তলিকতা ও হৃদয়বিদারী জাতিভেদ প্রথা ঢুকিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে তাহার ঐশ্বরিক ধর্মটিকে, পরধর্ম সংহারকারী একটি গোড়া ও রক্ষরণশীল ধর্মে পরিণত করে। যার ফলে পাক-ভারত থেকে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম প্রায় লোপ পায়। যার প্রভাবে এখানকার ধর্মান্তরিত মুসলমানেরা রাতারাতি তাদের হিন্দু ভ্রাতৃবর্গের চিরশত্রতে পরিণত হয়। কেবল ইসলাম ধম গ্রহণ করার অপরাধে হিন্দু আত্মীয়স্বজনদের সংগে ধর্মান্তরিত মুসলমানদের লক্ষকোটি বৎসরের রক্তমাংসের সম্পর্ক এক নিমিষে ঘুচে যায়। কায়েমী স্বার্থের ধ্বজাধারী হিন্দুগণ, স্থানীয় ধর্মান্তরিত কোটি কোটি মুসলমানকেও বহিরাগত মুসলমানদের পর্যায়ে ফেলে, পাক-ভারতের সকল মুসলমানকেই খেজুর তলায় তাড়ানোর অথবা সমুলে ধবংস করে দেওয়ার প্রকাশ্য দাবী উঠতে থাকে। এই ভাবেই তাহারা বহিরাগত মুসলমানদের নিকট অতীতে পরাজিত হওয়ার গ্রানি মুছে ফেলতে বদ্ধপরিকর হয়। ইংরেজদের হাতে পাক-ভারতের মুসলিম রাজশক্তির পতনের পর হিন্দু কায়েমী স্বাথবাদী গণের মুসলমান ধবংস করার সুযোগ আরো বৃদ্ধি পায়। তাহারা প্রাপ্ত সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে থাকে। হিন্দুমুসলিম উদারপন্থী নেতা ও মনিষীদের, হিন্দু-মুসলমান মিলনের বাণীর প্রতি বর্ণিত কায়েমী স্বার্থবাদীগণ বৃদ্ধাংগুষ্ঠি প্রদর্শন করে। ইংরেজ বেনিয়াদের সংগে একজোট হয়ে হিন্দু কায়েমী স্বাথবাদীগণ পাক-ভারতের প্রায় সকল জমিদারী-জোতদার, ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকুরী-বাকুরী; তাহদের নিজেদের কুক্ষিগত করে ফেলে। তাহারা পাক-ভারতের মুসলমান এবং বিশেষ করে বাংলার মুসলমানগণকে অদ্যুৎ চাষা-ভূষার জাতীতে পরিণত করে। প্রতিবেশী হিন্দু কায়েমী স্বাথবাদীদের অত্যাচার, অবিচার, অবমাননাকর ব্যবহার ও নির্মম শোষণে জর্জরিত হতে হতে এখানকার মুসলমান অধিবাসীগণ মরিয়া হয়ে উঠে। তাহারা হাড়ে হাড়ে, মজ্জায় অনুভব করতে থাকে পূর্বের সূৰ্য্য যেমন পশ্চিমে উদয় হওয়া সম্ভব নহে-পাক-ভারতের দুটি জাতি, হিন্দু ও মুসলমানের মিলনও সেরুপ সম্ভব নহে। তদুপরি হিন্দু ও মুসলমানের চাল-চলন, রীতি-নীতি, আচার-ব্যবহার ভিন্নমুখী। তাই মুসলমানেরা নিজেদের অস্তিত্ব এবং বিশেষ করে, তাহদের প্রাণের চেয়ে প্রিয় ধর্ম ইসলামকে রক্ষার জন্য পাক ভারতের মুসলীম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলি নিয়ে, পৃথক দুইটি স্বাধীন ও সার্বভৌম ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করার দাবী করেঃ পাক-ভারতের পূর্বাঞ্চল তথা বাংলা ও আসাম নিয়ে যাহার একটি হওয়ার কথা ছিল এবং বর্তমান পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে যাহার আরেকটি হওয়ার কথা ছিল ইতিহাসে, ইহাই লাহোর প্রস্তাব নামে খ্যাত। এই লাহোর প্রস্তাবের উপর ভিত্তি করেই, পাক-ভারতের মুসলমানেরা এবং বিশেষ করে বাংলা ও আসামের মুসলমানেরা তীব্র আন্দোলন আরম্ভ করে দেয়। অজস্র রক্ত ক্ষয় হয়। শেষ পর্যন্ত, ১৯৪৭ ইংরেজীর ১৪ই আগষ্ট পাক-ভারতের বুক চিরে বর্তমান পাকিস্তান জন্মলাভ করে। আমাদের হিন্দু ভ্রাতৃবর্গ, পাকিস্তানের চেয়ে প্রায় ৫ (পাঁচ) গুণ বৃহৎ হিন্দুস্থান, তাহদের নিজেদের অংশে প্রাপ্ত হন। সুতরাং আমাদের হিন্দু ভাইদেরও অসন্তুষ্ট থাকার কোন কারণ নাই। বরং লোক সংখ্যার অনুপাত হিসাবে মুসলমানদেরই অসন্তুষ্ট হওয়ার কথা। হবে? জন্মের পরপরই ইহাতে নানা জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। আমরা এখন এই জটিলতা সৃষ্টির কারণ নিয়ে আলোচনা করব।