পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/৬৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

605 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ দ্বিতীয় খন্ড আজকাল দেখা যায় ৬-দফাই বাজার মাৎ করে ফেলেছে। কিন্তু ৬-দফা একটি স্ববিরোধী, জগাখিচুড়ি দফাসমষ্টি। ইহা যেভাবে রচিত তাহাতে একটি কনফেডারেশন হয়। ফেডারেশন হয় না। পরিতাপের বিষয় যারা এই দফাগুলির উদ্যোক্তা, তারা আবার কনফেডারেশন চায় না। ইহাকেই বলে কলির লীলা। যাহা হউক বর্তমানে ছয়-দফার উদ্যোক্তারা যে বিষয়ের উপর জোর দিচ্ছে, তাহা হলো পূর্ব পাকিস্তান থেকে অর্থ পাচার বন্ধকরণ সম্বন্ধে। আমরা জানিনা-আদমজি, দাউদ, ইস্পাহানী, ইউসুফ হারুন ইত্যাদি অবাংগালী পুঁজিপতিদের শিল্প-বাণিজ্য, আমদানী-রপ্তানীর ব্যবসায়, ব্যাঙ্ক, ইনসিওরেন্স ইত্যাদি বিনা ক্ষতিপূরণে জাত্যায়ন না করলে কিভাবে পুঁজিবাজার বন্ধ হবে? অবাংগালী পুঁজিপতিদের সঞ্চিত লভ্যাংশ তথা বর্ধিত পুঁজি ঘুষ খেয়ে খেয়ে তথাকথিত বাংগালী নামধারী মন্ত্রী অথবা আমলারাই পূর্ব পাকিস্তানের বাহিরে পাচার করে দেবে। ঘুষ ছাড়াও ছয় দফার ৫(৪) নং দফা অনুসারে পূর্ব পাকিস্তানী পণ্য পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে পুঁজি পাচার করা যাবেঃ যাহা পরে বিদেশে রপ্তানী করে নগদ টাকায় রূপান্তরিত করা যাবে। ইহা ব্যতীত নিম্নমূল্যে চালান (আনডার ইনভয়েসিং) এবং আরো অন্য উপায়ে বাহিরে পুঁজি পাচার করা যায়। যাহা বুঝাতে গেলে আমাদের দেশের অনেক রাজনীতিকের মগজেই হাতুড়ি খুঁকতে হবে। ছয় দফার সবচেয়ে মারাত্মক ত্রটি হলো এই যে, ইহাতে উভয় অঞ্চলে বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্য, চাকুরীর বৈষম্য এবং বিশেষ করে সামরিক চাকরীর বৈষম্য দূর করা সম্বন্ধে কোন কর্মসূচী নাই। সকলেই জানেন সামরিক চাকুরীর বৈষম্যই হলো সকল অনাচারের মূল। “দেশের সংহতির স্বার্থে সামরিক বাহিনীতে বাংগালীর অনুপাত ৫৬% (শতকরা ছাপ্পান্ন) ভাগ করার নিমিত্ত, শাসনতন্ত্র পাশ করার পরের দিন, সামরিক বাহিনীতে কর্মরত পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার ও সৈন্যদের অর্ধেককে বাধ্যতামূলক বিদায় দেওয়া হবে এবং তদস্থলে খাটি পূর্ব পাকিস্তানীগণকে নিয়োগ করা হবে।”-বলে যদি শাসনতন্ত্রে মৌলিক অধিকারের আওতা বহির্ভূক্ত একটি দফা যোগ করা না হয় তবে একশত বৎসর পরেও সামরিক চাকরীর বৈষম্য দূর হবে না। অন্যান্য চাকুরীর বৈষম্য দূর করার জন্যও অনুরূপ ব্যবস্থার প্রয়োজন। ন্যাশন্যাল গার্ড থেকে সামরিক বাহিনীতে নেওয়া প্রায় ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) বাংগালীকে মাত্র একদিনের নোটিশে বিদায় করা হয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সাবেক বাড়তি ব্যয় আদায় করা সম্বন্ধে’ ছয় দফার নীরবতা রহস্যজনক। অধিকন্তু ইয়াহিয়া খানের আইন-কাঠামো মেনে নেওয়ার পর ছয় দফার জিগির অর্থহীন হয়ে পড়েছে। কোন কোন নেতা বলছেন, শাসনতন্ত্র পাশ হয়ে গেলে গণতন্ত্রের মাধ্যমে সকল বৈষম্য, সকল অনাচার হুড়হুড় করে দূর হয়ে যাবে। এর আগেও দু’দুটা শাসনতন্ত্র ছিল। উভয় শাসনতন্ত্রেই আঞ্চলিক বৈষম্য ও চাকুরীর বৈষম্য দূর করার মিঠা বুলি ছিল। কিন্তু তাতে চিড়া ভিজেনি। বৈষম্য দূর হওয়ার পরিবর্তে বেড়েছে। পূর্বেই বলা হয়েছে, প্রয়োজনবোধে ঘৃণিত সাম্রাজ্যবাদীগণ রাইফেলের সহায়তায় দেশের শাসনতন্ত্রকেও আস্তাকুড়ে ফেলে দেয়। তাই ভবিষ্যতে যত বেশী করে শাসনতন্ত্র পাশ হবে এবং নির্বাচন হতে থাকবে, বৈষম্যেও পরিমাণও সেই অনুপাতে বাড়তে থাকবে। কারণ, সাম্রাজ্যবাদীরা, নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের প্রায় সকলকেই টাকা দিয়ে খরিদ করে ফেলে। যাতে জনপ্রতিনিধিগণ সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থে কাজ করে। দৈবক্রমে, গণপ্রতিনিধিগণ, সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থের বিরুদ্ধে কোন কিছু করতে চাইলে পর, তাহারা যেকোন গন্ডগোল অথবা রায়ট লাগিয়ে সামরিক শাসন জারি করে দেয়। তথাকথিত রাজনীতিকরা মন্ত্রী হতে চায়। অর্থ চায়। প্রতিপত্তি চায়। দেশের মঙ্গল চায় না। তাই তথাকথিত রাজনীতিকদের উপর নির্ভর করে হাজার বৎসর নির্বাচন করলে ও এবং শত শত শাসনতন্ত্র পাশ করলেও উভয় অঞ্চলের বৈষম্য দূর হবে না। অধিকন্তু যে অমঙ্গল বৈ মঙ্গল করতে পারে না। কারণ, পেটে খেলে পিঠে সয়। আমরা সুদীর্ঘ ২৩ বৎসর যাবৎ নানা জাতের শাসনের লীলা-খেলা দেখেছি। পারিষদিক গণতন্ত্র দেখেছি। সামরিক শাসন দেখেছি। একনায়কত্ব দেখেছি। নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র তথা মৌলিক গণতন্ত্রও দেখেছি। আমাদের