পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/৮৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

812 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ দ্বিতীয় খন্ড সেখানে এর সংখ্যাসাম্যের প্রশ্ন থাকিবে না এবং প্রেসিডেন্টকে সরাসরি প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে নির্বাচিত হইতে হইবে। এই প্রসঙ্গে আমরা আরো উল্লেখ করিয়াছিলাম যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এই পর্যন্ত যে অবস্থা চলিয়া আসিতেছে, তাতে পদে পদে প্রতিটি ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্য নীতি অনুসৃত হইয়াছে। উদাহরণস্বরূপ আমরা বলিয়াছিলাম যে, কেন্দ্রীয় চাকুরী-বাকুরীতে পূর্ব পাকিস্তানীদের হিস্যা শতকরা ১ ভাগেরও কম; আজ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় দপ্তরে একজন পূর্ব পাকিস্তানী সেক্রেটারী নাই; যেখানে দেশরক্ষা বিভাগে কেন্দ্রীয় রাজস্বের শতকরা ৬৫/৭০ ভাগ ব্যয়িত হয়, সেখানেও পূর্ব পাকিস্তানের হিস্যা উল্লেখেরও অযোগ্য, ব্যবসা-বাণিজ্যে ও শিল্প এক অংশর মুষ্টিমেয় লোকের একচেটিয়া প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। দেশের পুঁজির শতকরা ১০ভাগও পূর্ব পাকিস্তানে গঠিত হয় নাই। তাছাড়া বৈদেশিক লোনেরও সিংহভাগ ব্যয়িত হইয়াছে পশ্চিম পাকিস্তানে। ইহার পর আবার করাচী হইতে ফেডারেল রাজধানী অপসারণ করিবার কালে সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানের কথা বিবেচনা না করিয়াই পিন্ডি ও ইসলামাবাদে ফেডারের রাজধানী স্থানান্তরিত করিয়া জাতীয় সম্পদ হইতে তথায় শত শত কোটি টাকা ব্যয় করা হইতেছে। এমতাবস্থায় পার্লামেন্টারী শাসন ব্যবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানীদের একমাত্র সান্তুনা ছিল যে, রাজনীতির ক্ষেত্রে অন্ততঃ তাঁদের সমান অধিকার রহিয়াছে এবং এই অধিকার প্রয়োগ করিয়া কালক্রমে তারাসকল বৈষম্য ও অবিচারের অবসান ঘটাইতে পরিবে। কিন্তু স্থিতিশীলতার নাম করিয়া দেশে যদি এমনি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়, যাতে সকল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাও এক ব্যক্তির হস্তে এই একই অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত হয়, তবে পূর্ব পাকিস্তানীদের সেই সান্তনার পথটুকুও রুদ্ধ হইবে। আর অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর কার জন্য আমরা প্রস্তাব দিয়াছিলাম যে, পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি ক্ষেত্রেবিশেষতঃ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ করিয়া গড়িয়া তোলার জন্য অতঃপর পূর্ব পাকিস্তানের দেওয়া হউক। বৈদেশিক কর্জ সম্পর্কে আমাদের প্রস্তাব ছিল যে, পূর্ব পাকিস্তান যে পরিমাণ বৈদেশিক লোন করিবে, সে তাহা সুদে-আসলে পরিশোধ করিবে। আমরা তখন মনে করিয়াছি যে, পূর্ব পাকিস্তানকে বৈষম্যের অভিশাপ হইতে সত্যিকারভাবে মুক্ত করিতে হইলে ইহাই নু্যনতম কার্যকরী ব্যবস্থা। ইহার দ্বারা পাকিস্তানের অখন্ডত্ব বিপন্ন হইবার প্রশ্ন নাই; ইহার দ্বারা পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতির উপর হামলা করিবার প্রশ্ন নাই। বরং ইহা একটি উদার প্রস্তাব। কিন্তু যে মুষ্টিমেয় লোক দেশের গোটা সম্পদের উপর কর্তৃত্ব বিস্তার করিয়া বসিয়া আছেন, যারা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের মঙ্গলামঙ্গল উপেক্ষা করিয়া নিজেদের কর্তৃত্ব ও ভোগ-বিলাসকেই প্রাধান্য দিয়া থাকেন, যারা পূর্ব পাকিস্তানকে তাদের মিল-কলে উৎপাদিত পণ্যের বাজার হিসাবে গণ্য করিতে চান, তারা এই প্রস্তাবকে বিকৃত করিবার চেষ্টা করিবেন জানি, কিন্তু আমাদের মনে কোন দুরভিসন্ধি নাই; বরং পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি যে অবিচার করা হইয়াছে, তাহাও ভুলিয়া গিয়া পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ দ্বারা পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়ন বিধান করিয়া পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলকে একইভাবে সুখী ও সমৃদ্ধিশালী করাই আমাদের লক্ষ্য। সহজভাবে চিন্তা করিলে বাঙালী জাতিত্ব বোধ অপরাধের কিছু নাই। বাঙালী, পাঞ্জাবী, পাঠান, সিন্ধী, বেলুচ মিলিয়াই পাকিস্তান। বাঙালী নিজেকে পাঠান বলিয়া জাহির করিলে কিংবা পাঞ্চাবী মুখে বাঙালী বলিলে তদ্বারা জাতীয় সংহতি গড়িয়া উঠে না; বরং উহা মোনাফিকেরই নামান্তর। পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের অংশবিশেষ। কিন্তু যে মাটি আমাদের ধারণ করিয়াছে, যে জলবায়ু সেবন করিয়া আমরা বাঁচিয়া আছি সেই মাটি, সেই দেশ, সেই মানুষকে ভুলিয়া কিংবা তার তরককার প্রশ্ন বাদ দিয়া আমরা ভুয়া দেশপ্রেমিক সাজিতে চাই না। বাঙগালীর পাকিস্তান সংগ্রামে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছে। বন্দুক-কামান বা কোন ব্যক্তিবিশেষের শক্তিশালী নেতৃত্বে পাকিস্তান অর্জিত হয় নাই। মানুষ নিয়া দেশ। আর পাকিস্তানের শতকরা ৬৫ ভাগ অধিবাসী বাস করে এই পূর্ব বাংলায়। তাঁদের প্রতি সুবিচার এবং তাদের ন্যায্য অংশ দাবী করিলে যদি বিকৃত অর্থ