পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/৮৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

815 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ দ্বিতীয় খন্ড বরং প্লান-পরিকল্পনার অর্থ বরাদ, শিল্প বাণিজ্যের গতি প্রকৃতি এবং দেশরক্ষা ও প্রশাসনিক বিভাগসমূহে লোক নিয়োগের বিশিষ্ট ধারার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকের মনে এরূপ আশংকাই দেখা দিয়াছে যে, আগামী কুড়ি বৎসরে বৈষম্যের মাত্রা সংকুচিত হওয়ার পরিবর্তে প্রসারিতই হইবে। যাই হোক, এ সম্পর্কে আপাতত বিস্তৃত আলোচনায় না গিয়া সম্প্রতি প্রকাশিত একটি খবরের প্রতি আমাদের দৃষ্টি নিবন্ধ করিব। বিদেশে অবস্থিত পাকিস্তানী দূতাবাস ও বাণিজ্য মিশণগুলিতে কর্মরত চাকুরীয়াদের ব্যাপারে একটি তুলনামূলক তথ্য উক্ত খবরে উল্লিখিত হইয়াছে। প্রকাশ, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থিত পাকিস্তানী দুতাবাদ, কূটনৈতিক মিশন ও বাণিজ্য মিশনসমূহে কর্মচারীর সংখ্যা আঠার হাজারের কম নয়। এই আঠার হাজার কর্মচারীর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানীর সংখ্যা মাত্র তিনশত দশজন; অর্থাৎ শতকরা দুই জনেরও কম। উপরন্তু উক্ত কর্মাচরীর মধ্যেও উচ্চপদে অধিষ্ঠিত অফিসারের সংখ্যা নগণ্য, অধিকাংশ কেরানী, টাইপিষ্ট, রিসেপশনিষ্ট, বয়-বাবুর্চি ইত্যাদি। পাকিস্তানের বৈদেশিক মিশনে পূর্ব পাকিস্তানীরা এই নিদারুন সংখ্যাল্পতা শুধু তথ্য হিসেবেই চমকপ্ৰদ নয়, ইহার তাৎপর্যও নানা দিক হইতে বিচার্য। পাকিস্তানের সরকারী রাজস্বের সিংহভাগ ব্যয়িত হয় দেশরক্ষা খাতে। দেশরক্ষার পরেই যে খাতে অধিক রাজস্ব ব্যয়িত হয় সেটা হইতেছে প্রশাসনিক বিভাগ। দেশরক্ষা বিভাগে পূর্ব পাকিস্তানীরা সংখ্যা কত তার সঠিক তথ্য জানা না থাকিলেও উহা যে তিন চার পার্সেন্টের বেশী নয় তাহা কোন কোন ভূতপূর্ব জাতীয় পরিষদ সদস্যের বক্তৃতাদি হইতে জানা গিয়াছে। প্রশাসনিক বিভাগেও পূর্ব পাকিস্তানীর সংখ্যা অন্য অঞ্চলের চাইতে অনেক কম। ১৯৬৪-৬৫ সালে পাকিস্তান সরকারের প্রশাসনিক বিভাগে আটষট্টি কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্ধ হয়। তার মধ্যে বত্ৰিশ কোটি টাকাই ব্যয়িত হয় পাকিস্তানের বৈদেশিক মিশনগুলির জন্য। শতকরা হিসেবে উহা দাঁড়ায় প্রশাসনিক বিভাগের জন্য বরাদ্দকৃত মোট অর্থের শতকরা সাতচল্লিশ ভাগ। অতএব দেখা যাইতেছে, সরকারের যে দুইটি বিভাগে সর্বাধিক রাজস্ব ব্যয়িত হয়, সে দুই বিভাগে পূর্ব পাকিস্তানীর নিদারুন সংখ্যাল্পতার দরুন প্রায় সমুদয় অর্থই এক অঞ্চলে থাকিয়া যায়। জনসাধারণের আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে উপরোক্ত দুই বিভাগের খরচের যে প্রভাব, পূর্ব পাকিস্তানীরা তাহা হইতে প্রায় সম্পূর্ণরূপেই বঞ্চিত থাকিয়া যাইতেছে। পূর্ব পাকিস্তানীদের আর্থিক জীবনের পক্ষে যে ইহা খুব ক্ষতিকর তাহা বলার প্রয়োজন করে না। কিন্তু এই দিকটি ছাড়াও আরো একটি গুরুত্বসম্পন্ন দিক আছে। পূর্ব পাকিস্তান দেশের অধিকাংশ অধিবাসীর আবাসস্থল। বহির্বিশ্বে পাকিস্তান, সম্পর্কে কোন ধারণা সৃষ্টি করিতে হইলে পূর্ব পাকিস্তানকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু বৈদেশিক মিশনগুলি যেভাবে পরিচালিত হইতেছে, তাহাতে অনিবার্যভাবেই দেশের পশ্চিমাঞ্চল পূর্বাঞ্চল অপেক্ষা বেশী প্রাধান্য পাইতেছে। পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে অনেক বিদেশী রাষ্ট্রে যে ব্যাপক অজ্ঞতা বিদ্যমান, তার কারণ ইহাই। ফলে পাকিস্তান বলিতে বিদেশে মোটামুটি পশ্চিম পাকিস্তানকেই বোঝাইয়া থাকে। একটি জাতি সম্পর্কে এরূপ খন্ডিত ধারণা যে সে জাতির জন্য কতটা ক্ষতিকর, তাহা ব্যাখ্যা করিয়া বলার দরকার পড়ে? এই কারণেই অতীতে আমরা বহুবার বলিয়াছি যে, পাকিস্তানের, বৈদেশিক মিশনগুলি পুনর্গঠন করিয়া উহাতে পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায়সংগত প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করা দরকার। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, কর্তৃপক্ষের কার্যকলাপে সেরূপ কোন উদ্যোগই পরিলক্ষিত হইতেছে না। পূর্ব পাকিস্তান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে বৈষম্য নীতির শিকার, বৈদেশিক মিশনের চাকুরী বৈষম্য সেই বৃহত্তর বঞ্চনারই অঙ্গ। এই বাস্তব সমস্যার সমাধান না হইলে এ সম্পর্কে কথাবার্তা বন্ধ করিয়া দিয়া কিভাবে দুই প্রদেশের তিক্ততা দূর করা যাইবে, আমরা অন্তত তাহা বুঝিতে পারি না।