পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৭৫

 হালিশহর এবং কোর্ট ভবন, এ দুটি স্থানে তখনো আমাদের সুদৃঢ় ঘাঁটি ছিলো। তা ছাড়া শহরের বিভিন্ন স্থানে আমাদের ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন দলগুলো তখনো শত্রুসেনাদের মোকাবিলা করছিলো। কিন্তু শেষে কুমিল্লা থেকে নতুন শত্রুদল দেওয়ানহাট ক্রসিংয়ের কাছে পৌঁছে গেলে আগ্রাবাদ এলাকা থেকে আমাদের সৈন্যদের হালিশহর ঘাটিতে সরে আসা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। শহরের অর্ধেক জনসংখ্যা ততক্ষণে গ্রামের দিকে চলে গেছে। অনেকে সরাসরি সীমান্তের দিকেও চলে যায়। সকলেই কেমন যেনো হতাশ হয়ে পড়ে। জনসাধারণ ঠিকই ভেবেছিলো যে, কোনোরূপ সাহায্য ছাড়া যুদ্ধে জয়লাভ আমাদের পক্ষে দেরি হবে। কারণ ইতিমধ্যেই তারা দেখছে আমাদের সৈন্যরা ভীষণ অসহায় অবস্থার মধ্যে যুদ্ধ করছিলো। আমাদের গোলাগুলির সরবরাহ ছিলো খুবই কম। একজন সৈনিকের হাতের অস্ত্র অকেজো হয়ে গেলে তাকে নতুন অস্ত্র না দেয়া পর্যন্ত সেই সৈনিকটিই অকেজো হয়ে পড়ে। কেউ আহত হলেও তার প্রাথমিক চিকিৎসা কিংবা তাকে অন্যত্র স্থানান্তরের তেমন কোন ব্যাবস্থা আমাদের ছিলো না। এমনকি একপর্যায়ে প্রয়োজনীয় পানি ও খাদ্য সরবরাহেরও কেউ ছিলো না। আমার ট্যাকটিক্যাল হেডকোয়ার্টারে অয়্যারলেস কিংবা আধুনিক কোন যোগাযোগ ব্যবস্থা পর্যাপ্ত না থাকায় বিভিন্ন রনাঙ্গনে যুদ্ধরত সৈনিকদের সাথে সার্বক্ষনিক যোগাযোগ রাখতে পারিনি। ফলে সর্বশেষ পরিস্থিতি অবহিত হওয়া এবং সে অনুসারে নতুন নির্দেশ দেওয়াও সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া যাতায়েতের জন্য যানবাহন সমস্যাও ছিলো প্রকট। আমরা যোগাযোগ এবং পরিবহনের অভাবেই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি বেশী। কুমিরায় আমাদের অবস্থান বিপন্ন হওয়ার সংবাদ একজন সংবাদ বাহকের মারফত তিন ঘণ্টা পর পাই। সংবাদ পাওয়ার আধ ঘণ্টার মধ্যেই আমি নতুন কিছু সৈন্য কুমিরার উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু তারা কুমিরার দুই মাইল দুরে পৌঁছানোর পূর্বেই কুমিরার পতন ঘটে। আমাদের সৈন্যরা ততক্ষনে হালিশহরের দিকে ফিরে আসতে থাকে। আরেকটি সংকট ছিলো ট্রেনিংপ্রাপ্ত শত্রু সৈন্যদের সাথে যখন অব্যাহতভাবে নতুন নতুন সৈন্য এবং অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যাদির সরবরাহ যোগ হচ্ছিলো, আমি তখন অসহায়ভাবে তা দেখছিলাম। একইভাবে দল বেধে আমাদের সামরিক লোকজনও শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছিলো।

 আমি যে কয়জন সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ শুরু করেছিলাম তার সঙ্গে একজনও নতুন সৈনিক কিংবা একটি মাত্র বুলেটও যোগ করতে পারিনি। ক্রমাগত শত্রু সৈন্যর মোকাবেলা করে আমাদের সৈন্যরা ক্লান্ত, অবসন্ন হয়ে পড়েছিলো। অনেকেই ২৫ তারিখের রাত থেকে এ পর্যন্ত এক মুহুর্তের জন্যেও চোখ বন্ধ করতে পারেনি। আমার রেলওয়ে হিলের ঘাঁটি সার্কিটহাউস এলাকা, মেডিকেল কলেজ, ডি সি হিল এবং হালিশহর ও কোট বিল্ডিংয়ের যুদ্ধে আমি নতুন সৈন্য ও অস্ত্র সরবরাহ প্রাপ্তির প্রত্যাশায় হতাশ হয়েছি বারবার। আর এই প্রত্যাশা যুদ্ধের সেই পর্যায়ে আমার সৈন্যদের অবসাদগ্রস্ত করে তোলে সাময়িকভাবে।

॥ চট্টগ্রাম শহরে চূড়ান্ত লড়াই ॥

 ৩০শে মার্চ। শহরে তখন কারফিউ চলছে। খুব ভোরে এক ভদ্রলোক চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগে অস্থিরভাবে অনবরত টেলিফোন করছিলেন। একটু আগে জানালা দিয়ে তিনি নারকীয় দৃশ্য দেখেছেন। একটি গাছের ওপর বাংলাদেশের পতাকা উড়ছিল। কয়েকজন পাকসেনা কিশোর বয়সের একটি ছেলেকে সেই পতাকাটি নামিয়ে ফেলতে বলে। ছেলেটি অনিচ্ছাস্বত্বেও গাছ বেয়ে উপরে উঠে এবং পতাকাটি খুলে আস্তে আস্তে ভাজ করতে থাকে। ঠিক এ সময়ে নিচ থেকে সৈন্যরা অত্যন্ত সুস্থ মস্তিস্কে তার দিকে রাইফেল তাক করে গুলি ছোড়ে। গুলিবিদ্ধ ছেলেটি বৃন্তচ্যুত ফুলের ন্যায় নিচে পড়ে যায়। সৈন্যরা হো হো করে হেসে ওঠে এবং সে স্থান ত্যাগ করে।

 কোনো এ্যাম্বুলেন্স কিংবা অন্য কেউ কিশোরটির সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। হাসপাতালের সবকটি গাড়িই পাকিস্তানী সৈন্যদের বহন করছিলো। বস্তুত পুরো হাসপাতালটিই মিলিটারী ক্যাম্পে পরিণত হয়েছিলো। বাঙালী ডাক্তার, নার্স এবং অধিকাংশ রোগী ইতিমধ্যেই হাসপাতল ত্যাগ করেছেন। আর রক্তপিপাসু দানবদের হাত থেকে পালাতে যারা একেবারেই অসমর্থ তারা অসহায়ভাবে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিলেন।