পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১০৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৭৮

 চট্টগ্রাম শহরের ওপর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানীরা গ্রামাঞ্চলের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানীদের একটি কলাম হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, নারায়ণহাট এবং হিয়াকু হয়ে রামগড়ের দিকে অগ্রসর হয়। অপরদিকে রাঙ্গামাটি কাপ্তাই, এবং কক্সবাজারের দিকেও একটি করে কলাম অগ্রসর হতে থাকে। এ সময় আমরা গ্রামাঞ্চলের উপর আমাদের নিয়ন্ত্রন বলবৎ রাখার সিদ্ধান্ত নিই। এ উদ্দেশ্য সাধন কেবল শত্রু সৈন্যদের শহরাঞ্চলে কোণঠাসা করে রাখার মাধ্যমেই সম্ভব ছিলো। এভাবে সুসংগঠিত গেরিলা যুদ্ধেও মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে শত্রুর শক্তিক্ষয় করে তাদের উপর চুড়ান্ত আঘাত হানাই হবে সঠিক পদক্ষেপ। এটা আমাদের কাছে পরিস্কার ছিলো যে, এই সুদীর্ঘ প্রক্রিয়ায় আমাদেরও হারাতে হবে অসংখ্য অমূল্য জীবন। আমাদের সামনে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ ব্যাতীত অন্য কোন বিকল্প ব্যবস্থা ছিলো না। এ জন্য অবশ্য জনসাধারণকে ও সীমাহিন দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে।

 রামগড় থেকে দুটি ইপি আর প্লাটুনকে চট্টগ্রাম শহরের প্রায় ছয় মাইল দুরে ভাটিয়ারি এবং ফৌজদার হাটের মধ্যে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহনের জন্য পাঠানো হয়েছিলো। অন্য দুটি ইপি আর প্লাটুনকে ফটিকছরি হাটহাজারী হয়ে ক্যাণ্টনমেণ্টের দিকে সহযোদ্ধাদের সাহায্যে পাঠানো হয়। ক্যাপ্টেন হারুন এবং আরো কয়েকজন অফিসার ৬টি কোম্পানী নিয়ে কালুরঘাট সেতুর নিকটেই প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নিয়েছিলো। ঠিক এ পর্যায়ে চৌঠা এপ্রিল আমরা ভারত থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদের প্রথম সরবরাহ পাই। যুদ্ধ পরিচালনার জন্য এ সময় আমাদের পুরো বাহিনীকে পুনর্বিন্যস্ত করা হয়। সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালী সদস্যদের গুরুত্বহীন স্থান থেকে সরিয়ে গুরুত্বপূর্ন যুদ্ধ ফ্রণ্টগুলোতে পাঠানো হল। ক্যাপ্টেন মতিন এবং লেফটেন্যাণ্ট এজাজের নেতৃত্বে এরুপ দুটি কোম্পানী ভারতীয় এলাকা দিয়ে। শতাধিক মাইল দুরে চট্টগ্রাম সেক্টরকে শক্তিশালী করার জন্য সেখানে পৌঁছে। আমাদের দলের শক্তি বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ এদের একটি কোম্পানী ভাটিয়ারী অভিমুখে রওয়ানা হয়। এবং অন্য একটি কোম্পানীকে নিয়ে আমি হিয়াকু, ফটিকছড়ি হয়ে পুনরায় চট্টগ্রাম ক্যাণ্টনমেণ্টের দিকে অগ্রসর হই। এটা ছিলো এক কষ্টসাধ্য অভিযাত্রা। রাস্তা ছিলো অত্যান্ত খারাপ। যান্ত্রিক কনভয় বলতে ছিলো দ্বিতীয়। বিশ্বযুদ্ধকালের কয়েকখানী জীপ, আর এই জীপ গুলোকে প্রায় অর্ধেক পথই আমাদের ঠেলে নিয়ে যেতে হচ্ছিল। আমাদের এই চলাচলের খবর গোপন রাখার উপায় ছিলনা। কারণ, যেমন দিনের বেলায় আমাদের চলতে হচ্ছিলো। তেমনি আবার ভারতের পথে পলায়নপর ভীতসন্ত্রস্ত অসংখ্য জনসাধারণ একই পথ ধরে অগ্রসর হচ্ছিল। যদিও আমরা সবাই বেসামরিক পোষাকে ছিলাম। এবং অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রেখেছিলাম, তথাপি শত্রুকবলিত একটি শহরের দিকে কিছুসংখ্যক লোকের সুসংগঠিত হয়ে চলার ভাব দেখে আশঙ্কা ও হতাশায় নিমজ্জিত লোকদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চর হয়। আত্মসন্তুষ্টি লাভের জন্য তারা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক সংখ্যর চেয়ে কয়েকগুন বাড়িয়ে শহরের দিকে তাদের যাত্রার কথা যেভাবে বলাবলি করছিলো সে খবর দ্রুত শত্রু ঘাঁটিতে পৌঁছে যায়।

 নারায়ণহাটে পৌঁছে আমরা সন্ধার পরবর্তী যাত্রার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। রাতের সামান্য আহার গ্রহণ করি। নারায়ণহাট থেকে আমাদের মুক্তি সেনাদের নাজিরহাট পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য কয়েকটি নৌকার ব্যবস্থা করা হয়। আকাশ ছিলো মেঘাচ্ছন্ন অন্যদিকে নৌকাগুলোরও কোন ছই ছিলো না। ক্লান্তিতে অবসাদে আমরা সবাই ঘুমিয়ে পড়ছিলাম। কিছুক্ষণ পর মুষল ধারায় বৃষ্টি নেমে আসে। আমরা বৃষ্টিতে ভিজে উন্মুক্ত আকাশের নীচে শীতে কাপতে থাকি। নাজিরহাট পৌঁছাতে ভোর হয়ে গেল। এখানেই খবর পেলাম ক্যাণ্টনমেণ্টের নিকট আমাদের যে সেনাদল ছিলো শত্রুর আক্রমণে তারা পিছু হটে হাটহাজারীর দিকে চলে গেছে। নাজিরহাট পৌঁছেই আমাদের জন্য একটি সম্ভাব্য ঘাঁটি খুজে বের করার উদ্দেশ্যে দ্রুত পর্যবেক্ষণের কাজ শুরু করি। খোজাখুজির পর কয়েক মাইল দূরে উদালিয়া চা বাগানই উপযুক্ত স্থান হিসেবে নির্ধারণ করি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সে দিকে রওয়ানা হলাম। বাগানের ম্যানেজার আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের স্বাগত জানালেন। সকল প্রকার সাহায্যের তিনি ব্যাবস্থা করেছিলেন।