পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১০৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৮১

পাশের গ্রামগুলো থেকে কিছুসংখ্যক চেয়ার জোগাড় করা হলো। সেসব চেয়ারের অধিকাংশের হাতল ছিল না। বেলা ১১টার মধ্যে অন্যান্য নেতারা পৌছে গেলেন। পাশ্ববর্তী এলাকার লোকজন এবং জনা পঞ্চাশেক বিদেশী সাংবাদিকও সবুজ শ্যামলিমায় ঘেরা আম্রকাননে উপস্থিত হলেন। এদের সমানেই সেদিন গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। শেখ মুজিবের নামানুসারে এ জায়গাটির নামকরন করা হয় মুজিবনগর। শেখ মুজিবর রহমানের নাম ঘোষনা করা হয় রাষ্ট্রপতি হিসাবে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম হন উপ-রাষ্ট্রপতি এবং ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান তখন পাক সামরিক জান্তার কারাগারে বন্দী। ইপিআর এর একটি প্লাটুন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করে।

 এদিকে ১৮ই এপ্রিল শত্রু বাহিনী আমাদের সীতাকুণ্ড অবস্থান ছত্রভঙ্গ করে দিলে এখান থেকে আমাদের সৈন্যদের মিরেশ্বরাইতে পশ্চাদপসরণ করতে হলো। আমরা জানতাম মিরেশ্বরাইতেও আমরা অলপ কিছু দিনের জন্য থাকতে পারবো, তারপর আবার সরে যেতে হবে। এই দুঃখজনক অবস্থা কতদিন চলবে তা কারো জানা ছিল না। সৈন্যরাও ক্রমে আস্থা হারিয়ে ফেলছিল। কোন অবস্থান প্রতিরক্ষায় নিজেদের যোগ্যতা সম্পর্কে নিজেরাই সন্দিহান হয়ে উঠছিলো। লোকবল এবং বিপুল অস্ত্রবলের সাহায্যে শত্রপক্ষ প্রতিটি যুদ্ধেই ইচ্ছামতো ফলাফল নির্ধারণ করে চলছিল। এই সংকটময় দিনগুলোতে আমাদের সবচাইতে বেশী দরকার ছিল কিছু ভাল অস্ত্রের। চিরাচরিত পন্থায় যুদ্ধ হচ্ছিল। অস্ত্রবল বৃদ্ধি করতে না পারলে আমাদের জয়ের কোন আশাই ছিল না। দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের বাংলাদেশ বাহিনীর কলকাতাস্থ সদর দফতরটি ছিল রণাঙ্গন থেকে বহুদূরে। সম্ভবতঃ এই দূরত্বের কারণেই যুদ্ধের পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের চাহিদা সম্পর্কে সদর দফতর কিছুটা উদাসীন ছিলেন। একদিকে আমাদের সামরিক দফতর থেকে বলা হতো যেভাবেই হোক ঘাটি দখলে রাখার জন্য দৃঢ় প্রতিরক্ষাব্যুহ রচনা কর। আবার উন্নত ধরণের অস্ত্রশস্ত্র চাইলে জবাব পেতাম, এটা তো গেরিলা যুদ্ধ, ভারী অস্ত্রের তেমন প্রয়োজন নাই। ওই জবাব গেরিলা যুদ্ধ সম্পর্কিত বই পড়া জবাব, না, ভারতের কাছে থেকে প্রয়োজনীয় অস্ত্র সংগ্রহে সরকারের অক্ষমতা তা আমরা জনতাম না। গেরিলা যুদ্ধে উন্নত অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়োজন নেই। এই উক্তিটি যে কত অসার, সে সময়ের পৃথিবীর অন্যান্য যেসব দেশে গেরিলা যুদ্ধ চলছিল, সেসব যুদ্ধ পর্যালোচনা করলেই বুঝা যায়। তাছাড়া আমরা শুধু গেরিলা যুদ্ধ করছিলাম না। সাথে সাথে প্রচলিত ধারার লড়াইও আমাদের করতে হচিছল। দেশের বেশ কয়েকটি স্থানে আমাদের সৈন্যরা প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে শত্রপক্ষের অগ্রাভিযান প্রতিরোধেরও চেষ্টা করছিল। প্রচলিত প্রথার এই যুদ্ধের পাশাপাশি ট্রেনিংপ্রাপ্ত ছোট ছোট গেরিলা দলকেও বাংলাদেশের ভেতরে পাঠানো হচ্ছিল।

 একাত্তরের যুদ্ধের এই বৈশিষ্ট অনেকেই পরিস্কারভাবে বুঝতে পারেননি। তাই আমাদের সরকার এবং সামরিক হেডকোয়ার্টারের কাছে আমাদের সুবিধা অসুবিধাও বোধগম্য হয়নি। সবচাইতে নাজুক অবস্থা ছিল হতো। সে সময়ের একটি ঘটনার কথা বলছি। তখন আমি সৈন্য নিয়ে মিরেশ্বরাই এলাকায় শত্রর সাথে যুদ্ধ করছিলাম। ৩” মর্টার গোলার ঘাটতি ছিল আমাদের এবং শত্ররা তখন আমাদের প্রতিরক্ষাব্যুহের ওপর কামান দেগে চলছিলো। শত্রশু গোলায় আহত একজন সৈনিক আমাকে জিজ্ঞেস করলো, আপনি আমাদেরকে কামানের আশ্বাস দিয়েছিলেন, কিন্তু কাফেরদের বিরুদ্ধে আমাদের কামান ব্যবহার করছেন না কেন? এ প্রশ্নের আমি কোন জবাব দিতে পারিনি। তবু আমার আশা ছিল, শেষ পর্যন্ত প্রয়োজনীয় সাহায্য আমি পাবোই। এটা আমার দুরাশা ছিল কিনা বলতে পারিনা। পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র পাওয়ার ইঙ্গিতের উপর ভিত্তি করেই আমি যোদ্ধাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম।

 শেষ পর্যন্ত যখন অস্ত্র পাওয়া যাচ্ছিল না এবং যোদ্ধাদের পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র দেয়া যাচ্ছিল না সে অবস্থায় সৈন্যদের ঘাঁটি আগলে থাকার নির্দেশ দেয়া আমাদের জন্য খুবই অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। এতদসত্বেও, আমি আমার বাহিনীকে দৃঢ় মনোবল নিয়ে তাদের অবস্থান রক্ষা করতে বাধ্য করছিলাম। এ ছাড়া আর কোন বিকল্প পথ ছিল না। কোন কোন সময় মনে হয়েছে সৈন্যদের আমরা গিনিপিগের মতো ব্যবহার করছি। ট্রেঞ্চ বসে