পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১০৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৮২

থেকে কেউই প্রাণ হারাতে চায় না। তারা যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধই করতে চেয়েছিলো, কিন্তু প্রচলিত যুদ্ধের সুযোগ ক্রমেই সীমিত হয়ে আসছিল।

 ২০শে এপ্রিল পাক-সেনাদের দুটি ব্যাটালিয়ন সর্বশক্তি দিয়ে মিরেশ্বরাইয়ের ওপর প্রচণ্ড হামলা চালায়। চুড়ান্ত আঘাত হানার পূর্বে প্রায় ২৪ ঘণ্টাই পাক কামানগুলো আমাদের অবস্থানের উপর আঘাত হেনে চলছিলো। মাটি খোড়ার সরঞ্জমাদি এবং অন্যান্য প্রতিরক্ষামূলক জিনিসপত্র না থাকায় তেমন শক্তিশালি বাংকারও আমরা তৈরী করতে পারিনি। অনেক সময়ই সৈন্যদের বেয়োনেট দিয়ে মাটি খুড়তে দেখেছি। উপরের আচ্ছাদন তৈরীর জিনিসপত্রও ছিল না। তাই আমাদের ব্যাংকার এবং ট্রেঞ্চগুলো কামানের গোলায় ভেঙ্গে পরছিলো। খোলা জায়গায় আমাদের সৈন্যরা শত্রুর সহজ শিকারে পরিণত হচ্ছিলো। যা আশংকা করেছিলাম, শত্রুরা এই সময় এয়ার বার্স্ট শেল নিক্ষেপ করতে শুরু করে। আমাদের সৈন্যরা এই ধরনের হামলার সাথে পরিচিত ছিল না। হতাহতের সংখ্যা বাড়তে থাকায় অবস্থান থেকে তারা হটতে শুরু করে। শত্রুপক্ষেও হতাহত কম হচ্ছিল না। পরপর তিন দফা আক্রমণে ওদেরকে শতাধিক সৈন্য হারাতে হয়। আমাদের ট্যাংকবিধ্বংসী গোলায় পাকিস্তানী সৈন্যবাহী আটটি যান প্রায় তিন ঘণ্টা যাবৎ জ্বলতে থাকে। মটরযানে অবস্থানরত বেশকিছুসংখ্যক সৈন্যও জ্বলন্ত দগ্ধ হয়। সন্ধার অন্ধকারে আমাদের সৈন্যরা পরবর্তী অবস্থান মস্তাননগরে প্রতিটি রক্ষাব্যূহ গড়ে তোলে। এই সময়ে শত্রুপক্ষেও আক্রমনকারী সৈন্যদের সাথে কয়েকটি ট্যাংক এসে যোগ দিলে সংঘর্ষ তীব্রতর হয়ে ওঠে।

 আমাদের সৈন্যরা মস্তাননগরে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করার পূর্বেই সেখানে শত্রুর কামানের গোলা এসে পড়তে থাকে। বাঙ্গালী সোনদের তখন খাদ্য ও পানি সরবরাহ করা যাচ্ছিল না। এমনকি গোলাগুলির যোগান দেওয়া কঠিন হয়ে উঠেছিলো। তবু তারা শেষ গুলিটি নিঃশেষ না হওয়া পর্যন্ত ঘাটি আগলে থাকে। শত্রুরা তখন ট্যাংক সামনে নিয়ে আমাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো। মস্তাননগরের অবস্থান টিকিয়ে রাখা দুস্কর হয়ে উঠলে আমি করেরহাটের কয়েক মাইল দক্ষিণে হিংগুলী এলাকায় সৈন্যদের নিয়ে যেতে মনস্থ করি। এখানে পূর্ব-পশ্চিম বরাবর একটি খাল থাকায় শত্রুদের দ্রুত আগ্রগমন সম্ভব ছিল না। অগ্রসরমান শত্রুর ট্যাংকের অগ্রযাত্রা থামাতে হলে খালের উপর প্রধান সেতুটি ধ্বংস করা দরকার।

 তখন প্রায় মধ্যরাত। আমাদের সৈন্যরা সবাই ক্লান্ত, অবসন্ন। তবু তারা দ্রুত হিংগুলীতে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গড়ে তোলে এবং পরবর্তী লড়াইয়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। রাতে কারো চোখে ঘুম ছিল না। পাকিস্তানীরা সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছিল। হিংগুলীর অদুরেই আমরা তাদের যানবাহন এবং ট্যাংকের আওয়াজ পরিস্কার শুনতে পাচ্ছিলাম। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আমি সেতুটি ধ্বংসের কাজে হাত দিলাম। আমাকে সহায়তা করছিলো বি এস এফ এর মেজর প্রধান।

 রাত ৭টা নাগাদ সেতুটি ধ্বংস করার সব ব্যবস্থা সম্পন্ন হলো এবং মেজর প্রধান সেই রাতেই সাবরুমের পথে রওনা হয়ে গেলেন। আমি তিরিশ সেকেণ্ডের একটি ফিউজে আগুন ধরিয়ে দ্রুত নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিই। এক এক করে সেকেণ্ড অতিবাহিত হয়, তারপর মিনিট, কিন্তু বিস্ফোরণ আর ঘটলো না। আসলে ফিউজটি খারাপ ছিল। আমার সঙ্গে অতিরিক্ত যে একটি ফিউজ ছিল তাও দেখা যায় অকেজো। ভোর হতে আর মাত্র দুঘণ্টা বাকী। এরই মধ্যে সেতু আমাদের ধ্বংস করতেই হবে। তখন আমার সামনে হিংগুলির ২৫মাইল দুরের রামগর থেকে ফিউজ নিয়ে আসা ছাড়া অন্য কোন পথ খোলা ছিল না। ট্যাংক এবং অন্যান্য গাড়ি ক্রমশ নিকট থেকে নিকটতর হচ্ছিল। রাত ৩টা। আমি তখন মরিয়া হয়ে ফিউজের জন্য খবর পাঠালাম। আমাদের নিজস্ব কোন বিস্ফোরনের মজুত ছিল না। ফলে সম্পূর্ণভাবে বি এস এফ এর উপর নির্ভর করতে হতো।

 রাতে আমরা দ্রুত হিংগুলি ঘাটিতে অবস্থান করছিলাম। ভোরে আবার তার পূনর্বিন্যাস করার দরকার হবে। ভয় ছিল এই পুনর্বিন্যাসের আগেই শত্রুরা এসে না পড়ে। সেতু ধ্বংস করা যায়নি। ট্যাংক এসে পড়লে পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করে। ইতিমধ্যে রামগড় ফেরার পথে মেজর প্রধান খবর পান যে, সেতুটি ধ্বংস করা