পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৮৩

সম্ভব হয়নি। এই সংবাদ পেয়ে তিনি দ্রুত কয়েকটি ফিউজ নিয়ে পুনরায় আমাদের হিংগুলি অবস্থানে আসেন। রাত তখন পোনে ৪টা। এসময় রামগড়ের দিক থেকে আমার দিকে অগ্রসরমান একটি জীপের আলো আমার নজরে পড়ে। মেজর প্রধান জীপ থেকে দৌড়ে এসে আমাকে একটি ফিউজ দিয়ে বলেন, এটা আশা করি কাজ করবে। না সেটাতেও কোন কাজ হলো না। শেষ পর্যন্ত চতুর্থ ফিউজ কাজ হলো। কর্ণবিদারী বিস্ফোরণের আওয়াজ কয়েকমাইল দূর থেকেও শোনা গেল। সেতুটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হওয়াতে অমাদের দুশ্চিন্তার অবসান হলো। আমরা দু'জনে আনন্দে বলে উঠলাম “চমৎকার”।

 শত্রুসৈন্যদের মুল দল তখন মাত্র মাইলখানেক দুরে। এদের পেছনেই ছিলো আর্টিলারী। দিনের প্রথম আলোয় আমরা তাড়াতাড়ি ঘাটি পুনর্বিন্যাসের কাজে হাত দিই।

 এই সংকটময় মুহুর্তে কুমিল্লা সেক্টর থেকে পাওয়া আমাদের একটি নিয়মিত কোম্পানীকে অন্য এক যুদ্ধ ফ্রণ্টে চলে যেতে হয়। আমার কাছে হিংগুলিতে তখন একশর বেশী লোক ছিল না, যাদের অধিকাংশ ইপি আর পুলিশ ও মুজাহিদ। আমাদের সৈন্যদের বেশীরভাগই মহালছড়ি এবং নরায়ণহাট এলাকার সংঘর্ষে ব্যাপৃত ছিল। আমাদের হিংগুলীর অগ্রবর্তী অঞ্চল ছিল প্রায় তিন মাইল বিস্তৃত। এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল রক্ষা করা অপরিহার্য। কুমিল্লা সেক্টরের কোম্পানীর কাছে কিছু ভাল অস্ত্র ছিল তা তারা নিয়ে গেছে। আমাদের ছিল মাত্র দুটি লাইট মেশিনগান। বাকীগুলো ছিলো সবই সেকেলে ৩০৩ রাইফেল। একটি ৩” মর্টার পাওয়া গেলেও সেটি আপন খেয়ালে চলতো। আমি বুঝতে পারছিলাম মাত্র একশ সৈন্য নিয়ে দুই ব্যাটালিয়ন শত্রুসৈন্যকে নিশ্চয়ই বেশীক্ষণ ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। নারায়ণহাটে সৈন্য চেয়ে আমি যে খবর পাঠিয়েছিলাম তাদের আসতে অন্তত দুদিন লাগবে। এখানে আমাকে এই দুইদিন শত্রুদের ঠেকাতে হবে। শত্রুরা আমার আসল শক্তি সম্পর্কে বিন্দুমাত্রও আভাস পেলে তৎক্ষনাৎ আক্রমন করে বসতো। সেতুর পূর্বদিকে পাহাড়ী এলাকা পর্যন্ত প্রায় সমতল। মাঝে মধ্যে ছোট ছোট ঢিবি, টিলা। সৈন্য চলাচলে এগুলো আড়াল হিসেবে কাজে লাগছিলো। এই সমতল এলাকাটির দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় দুই মাইল। সেতুর পশ্চিম দিকের এলাকা একেবারে সমুদ্র উপকুল পর্যন্ত আমাদের অরক্ষিত রাখতে হচ্ছিল। সৈন্যসংখ্যা বেশি না থাকায় আমি জনা তিরিশের মত লোক নিয়ে তাদের দুভাগে ভাগ করি। এরপর দুদলকে পূর্ব ও পশ্চিম দিকে পাঠাই। উদ্দেশ্য ছিল, তারা এমনভাবে চলাচল করবে যাতে দুর থেকে শত্রুরা বুঝতে পারে যে, দুটি অঞ্চল জুড়েই আমরা প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করছি। পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা সামনে এগিয়ে গিয়ে এক জায়গায় শুয়ে পড়ে এবং এমনভাবে হামাগুড়ি দিয়ে কোন মাঠ কিংবা ঝোপের পেছনে চলে আসতো যাতে শত্রুরা তাদের পেছনে হটে যাওয়া দেখতে না পায়। এখান থেকে উঠে আবার একটু প্রকাশ্যভাবেই আরেক যায়গায় যেতে থাকে। গোপনে পিছন থেকে এবং প্রকাশ্যে সামনের দিকে যাওয়ার এই প্রক্রিয়া বিভিন্নস্থানে বেশ কয়েকবার করে চলে। এতে শত্রুদের ধারনা জন্মায় যে এক একটি স্থানেই পঞ্চাশ ষাটজন করে বাঙ্গালী সেনা রয়েছে। অথচ আমাদের ছিল মাত্র পনেরজনের মতো। বিকাল পর্যন্ত আমরা কাজটি চালিয়ে যেতে থাকি। দূর থেকে কেউ এ দৃশ্য দেখলে নির্ঘাত মনে করবে সেতুর উভয় পার্শ্বে আমাদের পনের শত থেকে দুই হাজার সৈন্য প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করছে।

 এই অবস্থায় আমাদের বাদবাকী সৈন্যরা সেতুর নিকট রাস্তা কভার করে সুবিধাজনক স্থানগুলোতে প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তুলতে থাকে। সন্ধ্যা নাগাদ আমাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। পদ্ধতিটি কিছু সময়ের জন্য অবশ্যই কাজে লেগেছিলো। রাতে আমাদের সাড়া সম্মুখভাগ জুড়ে শত্রুর কামানের গোলাবর্ষণ শুরু হয়। দুই দিন পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে, তবু তারা এগিয়ে এসে আক্রমণ করলো না। এদিকে আমার দলেও নতুন সৈন্য এসে পৌঁছায়নি। এ সময় এক নতুন বিপদ দেখাদিলো। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিপুলসংখ্যাক সৈন্য এসে পড়ায় শত্রুরা প্রতিটি রণাঙ্গনে আরো বেশী করে সৈন্য পাঠাতে লাগলো। ১২০ এম এম মর্টারসহ আধুনি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত একটি পুরো ব্যাটালিয়ন ফটিকছড়ি, নাড়ায়ন হাট দিয়ে হিয়াকুর দিকে এগোয়। এদের অগ্রাভিযানের ফলে হিয়াকু এবং করেরহাট হিংগুলী এলাকার মধ্যবর্তী স্থানে আমাদের সকল সৈন্য আটকা পড়ার আশংকা দেখা দেয়। এই অবস্থায় আমি নারায়নহাট থেকে সৈন্য পাওয়ার আশা পরিত্যাগ করি।