পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১০৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৮৪

॥ রামগর ভস্মীভূত ॥

 ২৫শে এপ্রিল পাকিস্তানীদের হাতে করেরহাটের পতন ঘটে। তারপর তিন দিক থেকে রামগড় অভিমুখে অগ্রসর হয়। করেরহাট রামগড় সড়কে একদল, নারায়ণহাট হিয়াকু রামগড় পথে দ্বিতীয় দল এবং মহালছড়ি রামগড় সড়ক ধরে তৃতীয় দল অগ্রসর হতে থাকে। করেরহাট থেকে রমগড় যাওয়ার পথে পাহাড়গুলো দখল করার জন্য পাকিস্তানীরা পূর্বদিকে এগুচ্ছিলো। ফেনী নদীর শুভপুর সেতুর দিকেও কিছুসংখ্যক শত্রুসেনা অগ্রসর হচ্ছিলো। পক্ষকাল পরে এই সেতুর কাছেই এক রক্তক্ষয়ী লড়াই সংঘটিত হয়।

 করেরহাট এবং রামগড়ের মাঝামাঝি স্থানে ছোট বাজার হিয়াকু। শত্রুরা কিভাবে যেন জেনেছিলো আমরা রামগড়েই চট্টগ্রাম সেক্টরের সদর দফতর স্থাপন করেছি। কথাটি আংশিক সত্য, সম্পূর্ণ নয়। এখানে আমাদের কিছু জ্বালানী এবং খাদ্য মজুদ ছিলো। আরো ছিল আমাদের আহতদের চিকিৎসার জন্য অস্থায়ী একটি হাসপাতাল। এছাড়া ছিল ছোট্ট একটি ট্রেনিং ক্যাম্প। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহের পর থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের এখানে আমরা অস্ত্র ও বিস্ফোরক ব্যবহারের ট্রেনিং দিচ্ছিলাম। তবে প্রয়োজনে এখান থেকেও সবকিছু সরানোর প্রস্তুতি আমাদের ছিলো। রামগড় অবশ্য আমাদের মান সম্মানেরও প্রতীক হয়ে উঠছিলো। কারণ এটাই ছিলো আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন সর্বশেষ মহকুমা সদর দফতর। তাই আমরা স্থানটি প্রতিরক্ষার জন্য সম্ভাব্য সবরকম প্রস্তুতি গ্রহণ করি। এজন্য আমরা কয়েকটি সেতু ধ্বংস করে ফেলি। সীমিত সম্পদ ও শক্তির দিকে লক্ষ্য রেখে যতদূর সম্ভব ব্যাপক এলাকা জুড়ে সম্ভাব্য শত্রু হামলার স্থানগুলোতে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা গড়ে তুলি।

 রণকৌশলগত দিক থেকে তখন হিয়াক্কু এবং করেরহাটের মধ্যে আমাদের কোন সৈন্য রাখার উপযোগিতা ছিলো না। সৈন্যদের এখানে শত্রুবেষ্টনীর মধ্যে পড়ে যাওয়ার ভয় ছিলো। তাই সকল দিকের সব সৈন্য প্রত্যাহার করে হিয়াকু এলাকায় সমাবেশ করেছিলাম।

 অন্য পথে আরো পূর্বে মহালছড়িতে আমাদের সৈন্যদের ওপর ইতিমধ্যে শত্রুরা হামলা চালিয়েছিলো। আমাদের বাহিনী তখন আরো সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র চেয়ে বারবার খবর পাঠাচ্ছিলো। কিন্তু আমরা তাদের কিছুই পাঠাতে পারিনি।

 এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহের দিকে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার সর্বোচ্চ সামরিক কমাণ্ডের মতো কিছু একটা গঠন করেন। রণাঙ্গণের কমাণ্ডাররা কিন্তু সর্বোচ্চ সামরিক কমাণ্ড থেকে কোন আদেশ পাননি। বস্তুত: অভিযান সংক্রান্ত কোন আদেশই তাদের ছিল না। যে কোন মূল্যে শত্রু আক্রমন প্রতিহত করতে হবে। আমাদের প্রতি এটাই ছিল সেই বিমুর্ত হাই কমাণ্ডের একমাত্র নির্দেশ। যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তব চিত্রের সাথে এই আদেশের কোন সম্পর্ক ছিল না। শত্রুর অগ্রাভিযান কিছু সময়ের জন্য হয়তো বিলম্বিত করা যায়। কিন্তু প্রাণঘাতী লড়াইয়ের ময়দানে প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ ছাড়া শত্রুকে দমন করার চিন্তা আকাশ কুসুম স্বপ্নমাত্র। কেউ কেউ এই যুক্তি অনুধাবন না করেই খামখেয়ালী এবং অসঙ্গত আদেশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। অচিরেই আমাদের সৈন্যরা এই অদৃশ্য কমাণ্ডের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে এবং এর আসল অস্তিত্ব সম্পর্কেই সকলের মধ্যে সন্দেহ দেখা দেয়।

 পাকিস্তানীরা মহালছড়ি আক্রমন করেছিলো ২৭শে এপ্রিল। এখানে ছিলো প্রায় তিন হাজার সৈন্যর দুটি মিজো ব্রিগেড এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি নিয়মিত কমাণ্ডো কোম্পানী। আমাদের সৈন্যদের পাহাড়ী এলাকায় যুদ্ধের ট্রেনিং ছিল না। অস্ত্র ও রসদপত্রেরও অভাব ছিল। তাই মহালছড়িতেও আমাদের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়। পাকিস্তানীরা মিজোদের সামনের সারিতে পাঠিয়ে দিয়ে একটির পর একটি হামলা চালাতে থাকে। প্রথমে প্রতিবারই তাদের সে হামলা ব্যার্থ হয়ে যায়। হামলায় মিজোরা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পেছন থেকে পাকিস্তানী কমাণ্ডদের চাপের ফলে মিজোরা পেছনেও সরতে পারছিলো না। এমন কি কমাণ্ডোরা অস্ত্র দিয়ে এমন ভাব দেখাচ্ছিলো যে, কোন মিজো পালাতে চেষ্টা করলেই তাকে গুলি করা হবে। যুদ্ধ গড়িয়ে চলে