পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৮৯

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভাষণ দিলেন, তখন থেকেই আমরা বাঙ্গালী সৈন্যরা চিন্তা করছিলাম যে একটা গণ্ডগোল বাধাবে এবং দেশের স্বাধীনতার জন্য আমাদের সবাইকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। চট্টগ্রামের ষোলশহরে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কমাণ্ডার ছিলেন তখন কর্নেল জানজুয়া। মেজর জিয়াউর রহমান (পরবর্তীকালে লেঃ জেনারেল এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতি ছিলেন এই ব্যাটালিয়ানের সেকেণ্ড ইন কমাণ্ড। জেনারেল জিয়া এবং আমি ছাড়াও ৮ম বেঙ্গল রেজিমেণ্টে আরো কয়েকজন বাঙ্গালী অফিসার ছিলেন। ১৫ই মার্চ ৭১-এর দিকে আমি এই ব্যাটালিয়নে যোগদান করি। ২৫ শে মার্চ, ৭১ রাতে যখন হত্যাকাণ্ড শুরু হয়, তখন স্বভাবতঃই আমি বাঙ্গালী হিসেবে আমার যা কর্তব্য সেটাই করেছি। এতে জড়িয়ে পড়ার মত কিছুই নেই। একটা কর্তব্য ছিল। সমস্ত বাঙ্গালী সৈন্যরই কর্তব্য ছিল এটা। সবাই এতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। কিছু কিছু সৈন্য হয়তো সুযোগ পাননি কিংবা কিছুসংখ্যক সৈন্য আগেই ধরা পড়ে গিয়েছিলেন। আমাদের যেহেতু বাঙ্গালী ব্যাটালিয়ন ছিল সেই জন্য আমরা ধরা পড়িনি। আমরা আমাদের কর্তব্য করেছি মাত্র। ২৫শে মার্চ’ ৭১ রাতে যখন জেনারেল জিয়াকে চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে পাঠানো হলো মূলত সেই সময় থেকেই স্বাধীনতা যুদ্ধ আমাদের পক্ষ থেকে শুরু হয়।

 উক্ত দুর্যোগের রাত প্রায় ১১-৩০ মিনিট সময়ে আমরা টেলিফোনে জানতে পারলাম যে ঢাকায় হত্যাকাণ্ড শুরু হয়ে গিয়েছে। স্বভাবতঃই আমরা ধরে নিলাম ঢাকায় যখন হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছে, নিশ্চয় এটা সারা বাংলাদেশব্যাপী শুরু হয়ে গিয়েছে। কারণ সেনাবাহিনী তো মাত্র এক জায়গায় তাদের পরিকল্পনা কার্যকর করে না; এ জাতীয় পরিকল্পনা সব জায়গাতেই একই সময়ে কার্যকর করাই স্বাভাবিক। আমাদের কর্তব্য আমরা আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম। কারণ ২৫শে মার্চের আগে থেকেই আন্দোলন যে রুপ নিচ্ছিল, সে সবে যখনই আমাদের নিযুক্ত করা হতো ব্যারিকেড সরানোর জন্য কিংবা জনগণকে হটানোর জন্য, তখন আমরা তাদের বিরুদ্ধে কাজ কখনো ঠিকমতো করতাম না। কার্যত আমরা সেই চুড়ান্ত অসহযোগের সময় থেকেই আন্দোলনের প্রতি আমাদের সমর্থন জানাতে শুরু করি। কাজেই ২৫শে মার্চ ৭১ রাতে যখন হানাদার বাহিনী বাঙ্গালী হত্যাকাণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়ল, তখন আমাদেরও তাৎক্ষণিকভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া বাদে অন্য কোনও বিকল্প ছিল না।

 বাঙ্গালী হত্যাকাণ্ড শুরু হওয়ার খবর দিয়ে সম্ভবত আমাদের কাছে প্রথম টেলিফোন করেছিলেন চট্টগ্রামের হান্নান ভাই (চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি)। সম্ভবত তিনিই চট্টগ্রামে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিলেন।

 আগেই বলেছি, জেনারেল জিয়া এবং আমি একই ব্যাটালিয়নে ছিলাম। তিনি যেহেতু আমার চাইতে সিনিয়র ছিলেন, সেহেতু তিনিই আমাদের কমাণ্ডারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আমি তার দুনম্বর হিসেবে কাজ করেছি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা পর্যায়ে আমরা যে একই ব্যাটালিয়নে ছিলাম, এটা অনেকেই হয়তো জানেন না। বেশীরভাগ জনসাধারণের ধারণা আমরা আলাদা ছিলাম। আমরা একই সঙ্গে ছিলাম এবং একই সঙ্গেই বিদ্রোহ করেছিলাম। জেনারেল জিয়াউর রহমানও তার বিবৃতিতে উল্লেখ করেছেনঃ “আমি বিদ্রোহ করে পোর্ট থেকে ফিরে এসেই শওকতের কাছে এলাম, এবং শওকত আমার সাথে হাত মিলালো।

 প্রঃ এই যে দুঃসাহসিক কাজ আপনারা করলেন, এর পিছনে অন্যন্য ক্যাণ্টনমেণ্টের বাঙ্গালী সৈন্যদেরও পূর্ন সমর্থন ছিল এবং তারাও আপনাদের মত এগিয়ে আসছিলেন, এটা আপনারা বুঝেছিলেন কি?

 উঃ এটা আমি বলতে পারবো না। কারণ রাজনীতিতে আমি কখনো জড়াতাম না। কিন্তু এটা রাজনীতি ছিল না। এটা ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধ। এতে জাতির জীবন-মরণের প্রশ্ন জড়িত হয়ে পড়েছিলো। তাছাড়া অন্যান্য সেক্টর থেকে বাঙ্গালী সৈন্যরা এগুচ্ছিলেন কিনা সে তথ্য আমাদের জানার উপায় ছিল না। সে তথ্য জানা না জানার গুরুত্ব দেয়ার সময়ও তখন আমাদের ছিল না। এমনকি তখন আমার বাবা মা ছিলেন আমার স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েকে নিয়ে কুমিল্লায়। তাদের নিরাপত্তা সম্পর্কে চিন্তা করার অবকাশও তখন আমাদের ছিল না। কাজেই