পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৯৬

বাঁচানোর জন্য বাইরে চলে যাচ্ছে। পাক সেনাবাহীনী ট্যাংক, কামান এবং অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নির্দোষ, নিরীহ, নিরস্ত্র জনসাধারনের উপর বর্বরচিতভাবে অত্যাচার করছে। ঢাকা শহর একটা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। আমি অনেক্ষণ বসে থেকে চিন্তা করতে থাকলাম আমার এখন কর্তব্য কি। অয়ারলেস সেট খোলার হুকুম দিয়ে হেড কোয়ার্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে লাগলাম। অনেক চেষ্টার পরও কোন যোগাযোগ হল না। তবুও আবার চেষ্টা চালিয়ে যেতে বললাম। অনেক্ষণ পর আমাকে লে. মাহবুব এসে খবর দিল যে হেড কোয়ার্টারের সঙ্গে অতি কষ্টে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়েছে। আমি তাড়াতাড়ি দৌড়ে গেলাম অয়ারলেসে কথা বলার জন্য। যখন আমি কথা বলতে চাই, তখনই অপরদিক থেকে কর্নেল খিজির হায়াত কিংবা ক্যাপ্টেন আমজাদ পাঞ্জাবী জবাব দেয়। তাদের কাছে কোন কথাই খুলে বলা সম্ভব হচ্ছিল না। শুধু এটুকু বুঝতে পারলাম কর্নেল খিজির হায়াত এবং চতুর্থ বেঙ্গল এর বাকী অংশ কুমিল্লা থেকে ২৫ তারিখে বি- বাড়িয়া এসেছে। কর্নেল খিজির হায়াত আমাকে জানালেন সব কিছু স্বাভাবিক এবং তিনি আরো জানালেন যে অতি সত্বর তিনি একবার শমসেরনগর পরিদর্শনে আসবেন। আমি তাকে জানালাম এখানে সব শান্ত এবং আমার এখানে থাকার কোন প্রয়োজনই নাই এবং আমাকে ফিরে আসার অনুমতি দেওয়া হোক। তিনি জবাবে আমাকে শমসেরনগরেই থাকতে আদেশ দিলেন। কিছুক্ষণ পর আমি আবার অয়্যারলেসে কথা বলার চেষ্টা করি। এবার ক্যাপ্টেন গাফফারের (এখন মেজর) সঙ্গে কথাবার্তায় বুঝতে পারলাম যে ক্যাপ্টেন গাফ্ফারের নিকটে কোন পাঞ্জাবী অফিসার আছে। সেজন্য সব কথা খুলে বলতে পারছিল না। আমি শুধু বললাম যখন সুযোগ পাবে তখন মেজর শাফায়াত জামিলকে (বর্তমানে লে. কর্নেল) আমার সঙ্গে কথা বলতে বলবে। আরো কিছুক্ষণ পরে মেজর শাফায়াত জামিল আমার সঙ্গে অয়ারলেসে কথা বলেন এবং জানালেন ঢাকাতে পাক সেনাবাহিনী গণহত্যা চালিয়েছে এবং এখনো ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাচ্ছে। এই কথা চলছিল ২৬শে মার্চের সন্ধ্যা বেলায়। শাফায়াত জামিল লোকমুখে শুনেছেন যে সব লোক ঢাকা থেকে পালিয়ে কুমিল্লার দিকে এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে আসছে। মেজর শাফায়াত জামিল এবং ক্যাপ্টেন গাফফার আরো জানান যে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও সান্ধ্য আইন জারি করা হইয়াছে এবং ৪র্থ বেঙ্গলকে এটা কার্যকরী করতে বলা হয়েছে। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জনসাধারন সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে মিছিল বের করেছে। এমতাবস্থায় তাদের করণীয় কি তা আমার কাছে জানতে চাইলেন।

 আমার পক্ষে এ প্রশ্নের জবাব দেয়া কঠিন ছিল। আমি প্রায় ১০০ মাইল দুরে অবস্থান করছি। সমস্ত বাংলাদেশে আর কোথায় কি হচ্ছে সে সম্বন্ধে কোন জ্ঞান ছিল না। ঢাকা শহরে পাক বাহিনী ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছে এবং আরো অনেক জায়গাতেও করেছে। রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে এই মুহুর্তে কোন প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নেই যে তাদের কাছে কোন উপদেশ নেব। একদিকে সামরিক শৃঙ্খলা এবং কর্তব্যবোধ অন্যদিকে বিবেকের দংশন আমাকে পীড়িত করছিল। এই উভয় সংকটে পড়ে আমি আমার চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলি। মেজর শাফায়াত জামিলকে বললাম, আমাকে কিছুটা সময় দাও, আমি কিছুক্ষণ পরে বলব এবং সঙ্গে সঙ্গে বললাম কোন মতেই যেন গুলি চালানো না হয়। লোকজনকে বুঝিয়ে শান্ত করার চেষ্টা কর। চিন্তায় আমি আমার কামরার চতুর্দিকে পায়চারি করতে শুরু করলাম এবং এমন অবস্থায় চিন্তায় মাথা ঘুরপাক খেতে লাগল। আমি বসে পরলাম এবং লে. মাহবুবও (বর্তমানে ক্যাপ্টেন) সেখানে বসে ছিল। আমার সঙ্গে যেসব বাঙ্গালী সৈনিকরা ছিল। তারাও উদ্বিগ্ন হয়ে আমার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় ছিল অবশেষে আমার বিবেক আমাকে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করল। এই অণ্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে হবে। যদিও কোন রাজনৈতিক নির্দেশ সেই মুহুর্তে ছিল না তবুও বঙ্গবন্ধুর সেই ৭ই মার্চের ঘোষনার কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বলেছিলেন “এবার ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” আমি লে. মাহবুবকে ডেকে বললাম যে এই মুহুর্তে আমি স্বাধীন বাংলার আনুগত্য স্বীকার করলাম। এখনই সব সৈনিকদের বলে দাও আজ থেকে আমরা আর কেউ পাকিস্তানের প্রতি আনুগত নই। স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে দাও। এখন থেকে আমরা পাকসেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আরম্ভ করবো। সব সৈনিকদের তৈরী হতে বল। এখান থেকে আমরা ঢাকার দিকে রওনা দেব এবং ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টকে ব্রাহ্মণবারিয়াতে একত্রিত করতে হবে। লে. মাহবুব যেন এই নির্দেশের অপেক্ষায় ছিল।