পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১০০

সে দৌড়ে গিয়ে সবাইকে আমার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পরেই আমি শুনতে পেলাম বঙ্গশার্দুলদের শ্লোগান “জয় বাংলা”। আমি তাদেরকে প্রথমে শান্ত করলাম এবং বুঝিয়ে দিলাম আমাদের এখন থেকে যে সংগ্রাম শুরু হল সেটা কঠিন এবং বিপদসংকুল। সকলেই নিজেকে স্বার্থের উর্ধ্বে রেখে দেশ ওজাতির এবং বাংলাদেশ সরাকরের জন্য আত্মিয়স্বজন, আর্থিক কষ্ট এবং সব কিছু সুবিধা ত্যাগ করে আত্মবিসর্জন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আমি দেখতে পেলাম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সৈনিকরা সবাই দৃঢ় সংকল্পে থেকে আত্মত্যাগের মনভাব নিয়ে প্রস্তুত হয়ে আছে। প্রথমে অয়ারলেসে মেজর শাফায়াতের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করি এবং তাকে নির্দেশ দিই যেন সেও তৈরী থাকে। তাকে আরো বললাম, কুমিল্লার রাস্তার দিকে খেয়াল রাখতে। তাকে আরো বললাম যে আমি অতি শিগগিরই ব্রাহ্মণবারিয়াতে পৌঁছব। ইতিমধ্যে আমার সমস্ত লোক ব্রাহ্মণবারিয়াতে রওনা হবার জন্য তৈরী হয়ে যায়। আমি লে. মাহবুবের সঙ্গে কিছুক্ষসংখ্যক সৈন্য দিয়ে শ্রীমঙ্গলে পাঠিয়ে দেই এবং সেখানে ডিফেন্স নিতে নির্দেশ দিই যাতে আমাদের যাওয়ার পথে মৌলভীবাজার থেকে পাঞ্জাব রেজিমেণ্ট এসে বাধা দিতে না পারে। শমসেরনগর থেকে জঙ্গলের পথে রাত বারোটায় আমি আমার কনভয় নিয়ে রওনা হয়ে যাই। রাস্তায় আমাদের অগ্রসর অনেক ধীর ছিল। কারণ সমস্ত রাস্তায় ব্যারিকেড এবং কোন কোন জায়গায় রাস্তা কেটেও দেওয়া হয়েছিল। জঙ্গলের অনেক জায়গায় বিরাট গাছ কেটে রাস্তার উপর ফেলে দেওয়া হয়েছিল। এই সব প্রতিবন্ধক আমাদেরকে কেটে কেটে বা মাটি ফেলে পরিস্কার করে অগ্রসর হতে হবে। সব প্রতিবন্ধকের কাছেই অনেক লোক লুকিয়ে দেখছিল আমরা কি করি। যখনই তারা বুঝতে পারত আমরা বেঙ্গল রেজিমেণ্ট এবং ঢাকার দিকে বা ব্রাহ্মণবারিয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছি, তখনই তারা স্বতঃস্ফুর্তভাবে এসে ব্যারিকেড সরিয়ে ফেলতে এবং রাস্তাঘাট পরিস্কার করতে সাহায্য করত। তাদের সহায়তায় এবং সক্রিয়তায় আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল কম সময়ের মধ্যে এগিয়ে যাবার। এভাবে অতি মন্থর গতিতে এগোতে এগোতে আমি ভোর পাঁচটায় সাতছড়িতে পৌঁছলাম। এখানে আমার সৈনিকরা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়। এখানে এসে আমি আবার অয়ারলেসের মাধ্যমে ব্রাক্ষণবারিয়াতে যোগাযোগ করি। ঐ অবস্তাতে কর্নেল খিজির হায়াতের সঙ্গে আলাপ হয়। তিনি আমাকে আশ্বাস দেন যে সেখানে সব কিছু ঠিকঠাক। মেজর শাফায়াত জামিলও আমার সঙ্গে কথা বলে। সে তার উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং জানতে চায় আমি কোথায় এবং আসতে কেন দেরী হচ্ছে। আমি বললাম ভয়ের কোন কারন নেই কেননা আমি অনেক কাছে এসে গেছি। তাকে আশ্বস দিয়ে আবার রওনা হই। সকাল ৬টায় ব্রাহ্মণবারিয়া থেকে দশ মাইল দুরে মাধবপুরে পৌঁছি। এবং মেজর শাফায়াত জামিলের সঙ্গে অয়্যারলেসে কথা বলি। তিনি আমাকে জানান, সকাল দশটার সময় কর্নেল খিজির হায়াত একটা কনফারেন্স ডেকেছেন (আমি পরে জানতে পারি যে কুমিল্লা থেকে পাঞ্জাব রেজিমেণ্ট এর একটা কোম্পানী সেই সময়ে আসছিল।) কনফারেন্সের কথা যখন আমি শাফায়াতের কাছে শুনতে পেলাম তখন আমি যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হয়ে যাই এবং তাদের পরিকল্পনা সম্বন্ধে সন্দিহান হয়ে উঠি। আমি শাফায়াতকে তখনই নির্দেশ দিই আমার জন্য অপেক্ষা কর না। প্রয়োজন হলে সমস্ত পাঞ্জাবী অফিসারকে কর্নেল খিজির হায়াতসহ গ্রেফতার করে ফেল এবং যত পাঞ্জাবী সৈনিক আছে নিরস্ত্র কর। আমি আবার রওনা হয়ে গেলাম। পরে শুনতে পেলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে কি হয়েছে। দশটা বাজার দশ মিনিট আগে কর্নেল খিজির হায়াত মেজর নেওয়াজ, ক্যাপ্টেন আমজাদ কনফারেন্সে বসেছিল। এমতাবস্থায় মেজর শাফায়াত জামিল লে. কবির (বর্তমানে ক্যাপ্টেন) লে. হারুন (বর্তমানে ক্যাপ্টেন) হঠাৎ সেই কামরায় প্রবেশ করেন এবং পাঞ্জাবী অফিসারদের তাদের অস্ত্র সমর্পন করার নির্দেশ দেন। মেজর নেওয়াজ জিনি নিজে একজন কমাণ্ডো ছিলেন তিনি কিছুটা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন কিন্তু লে. হারুন ত্বরিত প্রচেষ্টায় তার সে চেষ্টা ব্যার্থ হয় এবং সব পাঞ্জাবী অফিসারকে তারা বাংলাদেশের নামে গ্রেফতার করে। ইতিমধ্যে বাকী বঙ্গশার্দুলরা বাইরে যে সব পাঞ্জাবী সৈনিক ছিল, তাদের নিরস্ত্র করে এবং যারা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে তাদের চরম শাস্তি প্রদান করা হয়। ব্রাক্ষণবাড়িয়া শত্রুমুক্ত করে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেওয়া হয়। দিনটি ছিল ২৭শে মার্চ। ইতিমধ্যে আমি ব্রাক্ষণবাড়িয়ার অতি সন্নিকটে এসে গেছি। আমার বাহিনী এবং শাফায়াতের বাহিনী বেলা ১১টার দিকে সম্মিলিত হয়। আমি বুঝলাম আমার প্রথম কর্তব্য হল যে সমস্ত এলাকা মুক্ত হয়েছে তা শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করা। আমি প্রথমেই অফিসারদের নিয়ে একা বৈঠক