পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১০১

করি এবং এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে কিভাবে কার্যকরী করতে হবে তার সম্বন্ধে আমার পরিকল্পনা জানাই। আমার এই পরিকল্পনায় সিদ্ধান্ত ছিল যে, আমরা মেঘনা নদীকে উত্তরে রেখে পশ্চিম প্রতিরক্ষা লাইন তৈরী করব এবং দক্ষিনে ময়নামতি সেনানিবাস পর্যন্ত মুক্ত করে প্রতিরক্ষা লাইন তৈরী করব এবং দক্ষিণে ময়নামতি সেনানিবাস পর্যন্ত মুক্ত করে প্রতিরক্ষা বন্দোবস্ত করব। উত্তর-পূর্বে মৌলভীবাজার থেকে সিলেট পর্যন্ত মুক্ত করে প্রতিরক্ষার বন্দোবস্ত করব। উত্তর-পূর্বে মৌলভীবাজার থেকে সিলেট পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকা মুক্ত করে সিলেটে আর একটি ঘাটি স্থাপন করব।

 এই পরিপ্রেক্ষিতে ভৈরববাজারে প্রথম দুটো কোম্পানী পাঠিয়ে দিই। আর একটা পার্টিকে কুমিল্লার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে অগ্রসর হতে বলি। মেঘনার পূর্ব পারে একটা প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরীর ব্যবস্থা করি। এছাড়া ব্রাক্ষণবাড়িয়ার চতুর্দিকে তিতাস নদীর চতুর্দিকে একটা আভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষাব্যূহ নির্মাণ করি। ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে একটা কোম্পানী দিয়ে সিলেটের দিকে অগ্রসর হবার জন্য পাঠিয়ে দেই। শ্রীমঙ্গলে তাদের সাথে স্থানীয় সংগ্রামী আনসার, মুজাহিদ এবং আরো কিছুসংখ্যক সৈন্য কর্নেল রবের নেতৃত্বে (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল) যোগ দেয়। এই দলটির সাথে পাঞ্জাব রেজিমেণ্টের যে সব সৈন্য মৌলভীবাজারে ছিল তাদের সাথে লড়াই হয় এবং পাঞ্জাবীরা অনেক হতাহত এবং ক্ষয়ক্ষতির পরে মৌলভীবাজার থেকে পালিয়ে যায়। সিলেট শহর পর্যন্ত তাদেরকে ধাওয়া করা হয়। ব্রাহ্মণবারিয়াতে আমি বেসামরিক প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তখন মহকুমা প্রশাসক ছিলেন জনাব রকিব। তিনি অত্যান্ত উৎসাহী, সাহসী এবং সংগ্রামী ছিলেন। তিনি সব সময় আমাদের সাথে ছিলেন। তিনি যুদ্ধ প্রচেষ্টায় বেসামরিক সাহায্যের যতটুকু প্রয়োজন ছিল যেমন রসদ সরবরাহ, যানবাহন যোগার, সৈনিকদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা, চিকিৎসা, আর্থিক সাহায্য তিনি অত্যন্ত উৎসাহ এবং উদ্দীপনা নিয়ে করেছেন। তিনি পুলিশ অয়ারলেসের মাধ্যমে বাংলাদেশের সমস্ত জেলা এবং মহকুমা প্রশাসকদের কাছে খবর পাঠিয়েছেন যে, মেজর খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্ট স্বাধীনতা যুদ্ধ করছে এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সিলেট পর্যন্ত বিস্তীর্ন এলাকা শত্রুমুক্ত করেছে। ঐ সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আমার সাথে জনাব তাহের উদ্দিন ঠাকুর, সাচ্চু মিয়া প্রমুখ রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা হয়। এবং তাদেরকে আমি আমার বাংলাদেশ সরকারের সাথে আমার আনুগত্যের কথা বলি। তারা আমাকে সব রকম সাহায্য সহযোগিতা করেন। তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করেন কিভাবে এই যুদ্ধ পরিচালনায় সহায়তা করা যায়। আমি তাদের অনুরোধ জানাই, যে কোনো উপায়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে যদি কোনো অস্ত্রশস্ত্র আনার বন্দোবস্ত করতে পারেন তাহলে আমি আমার এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরো সুন্দর ও শক্তিশালী করতে পারি। আমি তখন জানতাম যে, আমার কাছে যা গোলাবারুদ আছে তা নিয়ে বেশী দিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। তারা এই বার্তা নিয়ে আগরতলাতে চলে যান।

 এই সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসরমান পাঞ্জাবী সৈন্যদের সাথে আমার অগ্রবর্তী সৈন্যদের কোম্পানীগঞ্জে লড়াই হয়। এতে পাকিস্তানীরা অনেক হাতাহত হয়ে আবার কুমিল্লা সেনানিবাসের দিকে পশ্চাদপসরণ করে। ২৯শে মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে শত্রুসেনা প্রথম বিমান হামলা চালায়। এতে আমার একজন সৈনিক শহীদ হন। সেদিনই সন্ধ্যায় পাকিস্তানীদের একটা রেকি পার্টি (তথ্য অনুসন্ধানী দল) একজন অফিসার এবং ৮ জন সিপাহী সহ ব্রাক্ষণবাড়িয়াতে আসে। এই দলটি আমাদের অগ্রবর্তী ঘাটির এ্যামবুশে পড়ে যায় এবং অফিসারসহ সব শত্রুসেনা এবং একখানা গাড়ী ধ্বংস করে দিই। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উপর বিমান হামলা আরো চলতে থাকে এবং আমাদের প্রতিরক্ষা আরো অধিকতর শক্তিশালী হতে থাকে। আমি এই অবস্থাতে ভৈরব বাজার এবং নরসিংদীর ভিতরের রেলওয়ে লাইন অনেক জায়গায় বিচ্ছিন্ন করে দিই এবং আর একটা দলকে নরসিংদী পর্যন্ত অগ্রসর হওয়ার জন্য নির্দেশ দিই। আমার এই দলটির সঙ্গে ঢাকা থেকে আগত আর একটি সাবেক ইপিআর এবং দ্বিতীয় বেঙ্গলের কিছু সৈন্যের যোগাযোগ স্থাপন হয়। এই সম্মিলিত দলটি ঢাকা থেকে পাকসেনাদের অগ্রসরমান এক বিরাট বাহিনীকে অ্যামবুশ করে পর্যুদস্ত করে এবং ঢাকার দিকে পশ্চাদপসরণে বাধ্য করে।