পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১০২

 আমাদের তখনো বাইরে আর কোন প্রতিষ্ঠান বা বাঙ্গালী সেনাবাহিনীর আর কোন দলের সাথে যোগাযোগ হয়নি। অন্যান্য জায়গা সম্বন্ধে আমি সম্পূর্ণ অন্ধকারে ছিলাম।

 আমি জানতে পাই যে মেজর সফিউল্লাহ (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জে এসে তার দ্বিতীয় বেঙ্গলকে একত্রিত করেছে। আমি আরো জানতে পারলাম যে, সে তার মুষ্টিমেয় সৈন্য নিয়ে ঢাকা অভিমুখে যাবার পরিকল্পনা করেছে। এই সংবাদে আমি অতিশয় উদ্বিগ্ন এবং চিন্তিত হয়ে পড়ি। কারণ আমি জানতাম ঢাকাতে পাকিস্তানীদের অন্ততপক্ষে দুটো ব্রিগেড সৈন্য আছে। তাছাড়া সাঁজোয়া বাহিনীর ট্যাংক, গোলান্দাজ বাহিনীর কামান এবং বিমান বাহিনী আছে। এসব অত্যন্ত শক্তিশালী এবং আধুনিক মরনাস্ত্রে সজ্জিত। বিরাট পাক সেনার বিরুদ্ধে অল্প সংখ্যক সৈন্য ও অস্ত্র নিয়ে আক্রমন করার মানেই ছিল আমাদের শক্তিকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা। আমার সঙ্গে মেজর সফিউল্লাহর যোগাযোগের কোন ব্যবস্থা ছিল না। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে কিশোরগঞ্জ পর্যন্ত কোন সরাসরি রাস্তা না থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। অথচ তার সঙ্গে যোগাযোগ করা খুবই প্রয়োজন। তা না হলে এ সর্বনাশকে কিছুতেই রোধ করা যাবে না। অনেক চেষ্টার পর আমি একটা খালি রেলওয়ে ইঞ্জিনের ব্যবস্থা করলাম। ক্যাপ্টেন মাহবুবকে সেই ইঞ্জিনে বসিয়ে সোজা কিশোরগঞ্জ পাঠিয়ে দিলাম। তাকে বিস্তারিত বুঝিয়ে দিলাম। কোন কিছু করার আগে তিনি যেন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এবং সম্ভব হলে আমার সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ জানাই।

 এরপর ক্যাপ্টেন মাহবুব ফিরে এসে জানায় মেজর সফিউল্লাহ এবং সমস্ত সেনাদল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে আসছে। মেজর সফিউল্লাহ তার বাহিনীকে নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছেন এবং তিনি আমার হেড কোয়ার্টার তেলিয়াপাড়াতে আসেন। আমাদের দুটো দলের যোগাযোগ হওয়াতে আমাদের শক্তি ও মনোবল বেড়ে যায়। এরপর আমরা বসে আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্বন্ধে আলোচনা করি। আমরা জানতে পারি যে, পাকিস্তানীরা আমাদের আক্রমণ করার যথেষ্ট প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং আমরা পাকিস্তানীদের আকমণের কৌশল সম্বন্ধে বিশ্লেষণ করি এবং সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, পাকিস্তানী বাহিনী আমাদের উপর বিমান, হেলিকপ্টার এবং নদী পথে ঢাকার দিক থেকে আক্রমন করতে পারে। নদী পথে আক্রমণ করার জন্য তারা মেঘনার পথে গানবোটে আসতে পারে এবং মেঘনার দক্ষিণ পাড়ে ল্যাণ্ডিং করতে পারে এবং সাথে সাথে হেলিকপ্টারযোগেও কমাণ্ডো এবং শত্রুবাহিনী নামাতে পারে।

 যে বিস্তীর্ন মুক্ত এলাকা আমাদের আয়ত্তাধীন ছিল, সে সব এলাকাতে সৈন্য রাখার মতো আমার কাছে সৈন্য ছিল না। সেই জন্য আমি আমার ট্রুপসকে যেখানে পাক বাহিনীর অবতরণের এবং আক্রমণের বেশি সম্ভাবনা, সেই জায়গাগুলোতে ডিফেন্স নেওয়ার বন্দোবস্ত করি। এই সময়ে আমি জানতে পাই ৪র্থ বেঙ্গল এর জনা পঞ্চাশেক সৈন্য যারা কুমিল্লার দক্ষিণে জাঙ্গালিয়া ইলেকট্রিক গ্রীড স্টেশনে প্রহরায় ছিল সেই সব সৈন্যরাও ২৫শে মার্চের পর নিকটবর্তী একটা গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে এবং আমার নির্দেশের অপেক্ষায় আছে। আমি এই অবস্থাতে তাদের কাছে লোক পাঠিয়ে দেই এবং তাদেরকে আরও দক্ষিণে যেয়ে লাকসাম এবং কুমিল্লার মধ্যখানে লালমাই হিলের মধ্য প্রান্তে টেম্পল পাহাড় নামক এক জায়গায় প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ার নির্দেশ দিই। তাদের উপর এই নির্দেশ দিলাম যে, কুমিল্লা থেকে পাক বাহিনী লাকসাম, নোয়াখালী কিংবা চাঁদপুরের দিকে অগ্রসর হলে তাদের যেন এ্যামবুশ করা এবং বাধা দেওয়া হয়। এর মধ্যে আমি খবর পাই আখউড়া, কসবা, বুড়িচংখেলাতে পাকিস্তানী সেনা ইপিআর পোস্টগুলোতে বাঙ্গালী ইপিআরদের বিরুদ্ধে এখনো লড়াই করে যাচ্ছে। এই সংবাদ পেয়ে আমি ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনকে (বর্তমানে মেজর) পাঠাই কিছু লোকজন নিয়ে যাতে বাঙ্গালী ইপিআরদের নিয়ে সম্মিলিতভাবে এই সব পোস্টগুলো পাঞ্জাবীদের কবল থেকে মুক্ত করা যায়। বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ইপিআর এবং স্থানীয় জনসাধারণের সম্মিলিত হামলায় অনেক ক্ষয়ক্ষতি এবং হতাহতের পর পাঞ্জাবীরা এই সব অবস্থান থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এই সব খণ্ডযুদ্ধের পর ব্রাক্ষণবাড়িয়া থেকে কুমিল্লার গোমতী পর্যন্ত আমি সমস্ত এলাকা মুক্ত করতে সমর্থ্য হই এবং কুমিল্লা শহরের বিবিরবাজার নামক একটা জায়াগায় একটা প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তুলি।