পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১০৩

 ইতিমধ্যে তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এবং সাচ্চু মিয়ার প্রচেষ্টায় আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রের কিছু সাড়া পাওয়া যায়। সীমান্তে আমার সঙ্গে আগরতলার জেলা প্রশাসক মি. সাইগলের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। বাংলাদেশের ঘটনাবলী সম্বন্ধে তখনও তাদের কোন ধারণা ছিল না। আমার কাছে বিস্তারিত জানতে পেরে তিনি আমাকে জানালেন যে এ সম্বন্ধে তিনি তার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবেন। তাকে আমি অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানাই। তিনি সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে যান। কয়েকদিন পর আবার সীমান্ত এলাকায় ভারতের সেনাবাহিনীর ৫৭তম ডিভিশনের কমাণ্ডার মেজর জেনারেল গানজালভেজ এর সঙ্গে দেখা হয়। তাকেও আমি ঘটনাবলীর বিস্তারিত বিবরণ দিই। তখন পর্যন্ত আমরা কোনো সাহায্য পাইনি।

 এপ্রিল মাসের ২/৪ তারিখে কুমিল্লার সীমান্তে মতিনগরের নিকট কর্নেল এম এ জি ওসমানী (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল) যখন ভারত সীমান্তে পৌঁছেন তখন আমার সঙ্গে তার দেখা হয়। তিনি প্রথম আমার কাছে সংক্ষেপে আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি সম্বন্ধে ওয়াকেবহাল হন এবং তার পরই তিনি আগরতলাতে চলে যান। পরের দিন সন্ধ্যায় আমার হেড কোয়ার্টার তেলিয়াপাড়াতে কর্নেল ওসমানী আমাকে মেজর সফিউল্লাহ লে. কর্নেল রবকে (বর্তমানে মেজর জেনারেল) নিয়ে একটা বৈঠক করেন। এই বৈঠকে আমরা যুদ্ধের বর্তমান পরিস্থিতি সম্বন্ধে সম্পূর্ণভাবে তাকে জ্ঞাত করি। আমি তাকে আরও জানাই, আমাদের যে শক্তি আছে তা দিয়ে বেশি দিন পাকবাহিনীকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। অতিসত্বর বন্ধুরাষ্ট্র থেকে বা অন্য কোন জায়গা থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদের ব্যাবস্থা করতে হবে। এছাড়া তাকে আরো অনুরোধ করা হয় আরো নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে অতি শিগগির আমাদের বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হউক যাতে আমরা বহির্জগতের স্বীকৃতি পাই এবং যুদ্ধের সময় রাজনৈতিক নেতৃত্ব পাই। তিনি আমাদের বক্তব্য বুঝতে পারলেন এবং আগরতলা থেকে কলকাতা চলে গেলেন। কিছুদিন পর ১৭ই এপ্রিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে স্বীকার করে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী করে বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়।

 এই সময় বন্ধুরাষ্ট্র থেকে বিএসএফ এর ব্রিগেডয়ার পাণ্ডে আমাদের হেডকোয়ার্টার আসেন এবং আমাদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি আপ্রান চেষ্টা করেন আমাদের সহায়তা করার কিন্তু সে সাহায্য ছিল নগণ্য। আমরা চাচ্ছিলাম হালকা এবং ভারী স্বয়ক্রিয় হাতিয়ার মর্টার। কিন্তু সে সময় আমাদেরকে খুবই সামান্য ৩০৩ রাইফেল এবং সামান্য গুলি সাহায্য দেওয়া হয়। তা ছিল আমাদের দরকারের চেয়ে অনেক নগন্য। এই সময়ে ব্রিগেডিয়ার পাণ্ডে আমাদেরকে মেজর জিয়াউর রহমান সম্বন্ধে বিস্তারিত জানান এবং একদিন মেজর জিয়াউর রহমানকে (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) সঙ্গে নিয়ে আসেন। তিনি বলেন, পাক বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেণ্টের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং যুদ্ধ করার জন্য তার কাছে অতি নগন্যসংখ্যক সৈন্য আছে এবং তিনি আমাকে ও মেজর সফিউল্লাহকে মেজর জিয়াউর রহমানকে কিছু সৈন্য দেওয়ার অনুরোধ করেন। আমি এবং মেজর সফিউল্লাহ নিজ নিজ বাহিনী থেকে দুটো শক্তিশালী কোম্পানী গঠন করে মেজর জিয়াউর রহমানের নিকট প্রেরণ করি।

 এই সময় পাকবাহিনী আশুগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে আমাদের সম্মিলিত বাহিনীর ওপর প্রবল বিমান আক্রমন চালাতে থাকে। এই আক্রমন এতই ভয়াবহ রুপ ধানর করে যে, মাঝে মধ্যে ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা অনবরত স্ট্রাপিং রকেটিং এবং বোম্বিং করতে থাকে। এপ্রিল মাসের শেষে পাকবাহিনী বিমান বাহিনীর সহায়তায় হেলিকপ্টার এবং গানবোটের সাহায্যে আমাদের আশুগঞ্জ পজিশনে সৈন্য অবতরণ করায়। আমাদের সৈন্যরা শত্রুদের বিমান বাহিনী এবং ছত্রীদের সম্মিলিত সাড়াশি আক্রমনের মুখে অসহায় হয়ে আশুগঞ্জ থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পিছু হটে আসে। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও শত্রুবাহিনীর সাথে আমাদের সম্মিলিত বাহিনীর প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয় এবং এপ্রিল মাসের শেষ পর্যন্ত আমরা শত্রুসেনাকে ঠেকিয়ে রাখি এবং শেষ পর্যন্ত শত্রুদের সাজোয়া বাহিনী বিমান বাহিনী এবং গোলন্দাজ বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমনে আর টিকতে না পেরে আমরা দুই রাস্তায় পিছু হটে গেলাম। আমার সৈন্যরা ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে আখাউড়াতে এসে তিতাস নদীর উপর পুনরায়