পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১০৫

থেকে শত্রুদের গঙ্গাসাগর পজিশনের পিছন দিক দিয়ে ইনফিলট্রেট করে ভিতরে ঢুকে গঙ্গাসাগরের উপর আক্রমণ চালাবে এবং এই সময়ে সুবেদার তার আলফা কোম্পানী নিয়ে নিয়ামতাবাদের উপর যে জায়গাতে আমরা শত্রুদের হেড কোয়ার্টার ভেবেছিলাম, সেখানে আক্রমণ চালাবে। এ দুই আক্রমণ এক সঙ্গে চারটায় শুরু হবে। আক্রমণের ঠিক দশ মিনিট আগে সুবেদার শামসুল হকের নেতৃত্বে ৪র্থ বেঙ্গলের মর্টার এই দুই পজিশনের উপর গোলা ছুঁড়বে। রাত বারোটায় এই পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি এই তিন কোম্পানী নিয়ে শত্রুদের ঘাটিতে ঢুকে যাই। সেদিন টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। চতুর্দিকে বেশ পানি জমছিল। আমাদেরকে হাটু পানি ভেঙ্গে ত্রাসের রাস্তায় অগ্রসর হতে হচ্ছিল। এক সয়ে আমার মনে হচ্ছিল আমরা যেন আমাদের ঠিক পথে যাচ্ছি না এবং এই সময়ে নিকটবর্তী একটা বাড়ির একটা লোকের সঙ্গে দেখা হয়। সেও একজন পুরানা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ব্যাক্তি ছিল। এই ব্যাক্তি আমাদেরকে শত্রুদের অবস্থান সম্পর্কে দিনে দূরে থেকে যা দেখেছে সে সম্বন্ধে আরো বিস্তারিত খবর দেয়। এই ব্যাক্তির সাহায্যে আমি এবং আমার প্রত্যেকটি দল ভোর পাঁচটায় আমাদের লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে যাই। আক্রমণ করার সময় নির্দিষ্ট ছিল রাত চারটা। যেহেতু আমরা দেরীতে পৌঁছি সেহেতু পাচটায় পরিল্পনামত আক্রমণ শুরু করে দিই। শত্রুসেনারা অকস্মাৎ তাদের অবস্থানে এবং পিছনে ভয়ংকর গোলাগুলির শব্দ শুনে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ যুদ্ধ করার পর তারা গঙ্গাসাগর এবং নিয়মাতাবাদ ছেড়ে সাইদাবাদে পশ্চাদপসরণ করে। আমরা পরের দিন সকালে গঙ্গাসাগরে আবার প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তুলি। শত্রুসেনারা গঙ্গা সাগরে পর্যুদস্ত হয়ে কসবার দিকে অগ্রসর হবার চেষ্ট করে। তাদের প্রথম আক্রমণ আমরা ব্যর্থ করে দিই কিন্তু পড়ের গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় পাকসেনারা টি, আলীর বাড়ি পর্যন্ত অগ্রসর হয় এবং ঘাঁটি গড়ে তোলে। আমরা আমাদের কসবা পুরানা বাজারে পজিশন শক্তিশালী করে তুলি এবং শত্রুসেনাকে কসবার দিকে অগ্রসর হতে বাধা দেই। টি, আলীর বাড়িতে শত্রুসেনাদের যে ঘাঁটি ছিল সে ঘাঁটিতে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল-এ ডেল্টা কোম্পানী মর্টারের সহায়তায় ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন অকস্মাৎ আক্রমন করে। এই আক্রমণে শত্রুদের চার পাঁচটা গাড়ীতে আগুন লেগে যায় এবং তাদের ২০/৩০ জন হতাহত হয় তারা টি, আলীর বাড়ী ছেড়ে আরো পেছনে হটে যায়।

 ইতিমধ্যে কুমিল্লা বিবিরবাজার পজিশনের উপর পাক বাহিনী প্রচণ্ড আক্রমণ করতে শুরু করে এবং অনেক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে কুমিল্লা শহারের সন্নিকটে দেড় মাইল পূর্বদিকে তারন্যপুর শত্রুরা দখল করতে সমর্থ হয়। আমি ইপিআর-এর একটি কোম্পানী এবং কিছুসংখ্যক বেঙ্গল রেজিমেণ্ট-এর সৈন্য দিয়ে বিবিরবাজার প্রতিরক্ষাব্যূহ আরও ইপি আর-এর একটি কোম্পানী এবং কিছুসংখ্যক বেঙ্গল রেজিমেণ্ট-এর সৈন্য দিয়ে বিবিরবাজার অবস্থানটির উপর পাকসেনাদের লক্ষ্য এ জন্য ছিল যে প্রতি রাত্রে এখান থেকে 'আমার ছোট ছোট কমাণ্ডো পার্টি গোমতী নদী অতিক্রম করে কুমিল্লা শহরে পাকিস্তানী অবস্থানের উপর অতর্কিত হামলা চালাতো এবং ব্যতিব্যস্ত করে তুলতো। এখান হতে আমরা অনেক সময় তাদের অবস্থানের উপর মর্টার হামলাও চালাতাম। এতে প্রায়ই পাক সেনাদের অনেক লোক হতাহত হত। অবশেষে পাক বাহিনী একদিন সন্ধার সময় অতর্কিতে এই পজিশনের উপর ৩৯তম বেলুচ রেজিমেণ্টর সাহায্যে গোলন্দাজ বাহিনী এবং ট্যাংকের সহায়তায় প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। প্রথমে শত্রুসেনা পূর্ব দিকে আক্রমণ চালনা করে। এই আক্রমণ আমার সৈনিকরা নস্যাৎ করে দেয় এবং শত্রুদের অনেক লোক নিহত এবং আহত হয়। এরপর শত্রুসেনারা দক্ষিণ দিক হতে আমাদের পজিশনের উপর পিছনে বাম পার্শ্বে ট্যাংক ও ৩৯তম বেলুচ রেজিমেণ্টের সাহায্যে আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণ অন্ততপক্ষে চার-পাঁচ ঘণ্টা স্থায়ী থাকে। আমাদের গুলিতে শত্রুদের অন্ত ১১০ থেকে ১৫০ জন নিহত বা আহত হয়। কিন্তু ট্যাংক এবং গোলন্দাজ বাহিনীর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণে এবং পিছন দিক হতে ঘিরে ফেলার আশংকা থাকায় আমাকে বাধ্য হয়ে এই অবস্থান ছাড়তে হয়।

 এই যুদ্ধে ইপিআর জওয়ানরা যথেষ্ট সাহসের পরিচয় দিয়েছে। বিশেষ করে মনে পড়ে এক নায়েকের কথা, যে শত্রুদের গুলি করতে করতে এত উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল যে, তাদের নিহতের বিপুল সংখ্যা দেখে এক পর্যায়ে 'জয় বাংলা' হুংকার দিয়ে দাড়িয়ে পড়ে এবং সেই সময়ে হঠাৎ দুর্ভাগ্যবশত তার মাথায় গুলি লাগে এবং