পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১০৬

সে মারা যায়। এ যুদ্ধে আমার ৬ জন সৈন্য মারা যায় এবং ৮/১০ জন আহত হয়। এই সব আহতদের আমরা পিছনে নিয়ে আসি কিন্তু দুর্ভাগ্যবসত তাদের চিকিৎসার বন্দোবস্ত করতে পারি না। এ রকম একজন আহত তরুণ ছাত্রের কথা মনে পড়ে যায় পেটে গুলি লেগেছিল কিন্তু তৎক্ষণাৎ অপারেশন করার কোন ব্যাবস্থা না থাকায় সে মারা যায়।

 এদিকে গঙ্গাসাগরে এবং আখাউড়ায় শত্রুসেনারা আবার তৎপর হয়ে ওঠে এবং বারবার আখাউড়া এবং গঙ্গাসাগরের উপর আক্রমণ চালায়। জুন মাসের প্রথমে পাকবাহিনীর ১২ তম ফ্রণ্টিয়ার ফোর্স ট্যাংক, কামান এবং বিমান বাহিনীর সহায়তায় আখাউড়া রেলওয়ে স্টেশন এবং গঙ্গাসগারের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে ৪র্থ বেঙ্গলের ডেল্টা কোম্পানী কিছুটা পিছু হটে আজমপুর, আখাউড়া রেলওয়ে স্টেমন থেকে আধা মাইল পূর্বে আবার প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তোলে। এই প্রতিরক্ষাব্যূহ সিলেট, চট্টগ্রাম, ঢাকা রেলওয়ে লাইনকেও শত্রুদের ব্যবহার থেকে বাধা দিতে সমর্থ। এই অবস্থানগুলির উপর পাক বাহিনী বারবার আক্রমণ চালায় এবং প্রতিবারই ৩০/৪০ জন করে সৈন্য হতাহত হওয়ায় তারা আক্রমণ থেকে নিরস্ত থাকে।

 মে মাসে জেনারেল ওসমানী আমাদের হেড কোয়ার্টার-এ আসেন। সে সময় ভবিষ্যৎ যুদ্ধ পরিচালনা কিভাবে হবে সে সম্বন্ধে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। জেনারেল ওসমানী আমাকে নির্দেশ দেন যুদ্ধ পরিকল্পনা তৈরি করে ফেলি। এই পরিকল্পনায় আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে দুই বাহিনীর দ্বারা পরিচালিত করার পন্থা নিই। আমরা পরিকল্পনা করি যে, পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হেলে আমাদের শক্তিকে আরো বাড়াতে হবে। দুই রকমের বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। নিয়মিত বাহিনী, যা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট, ইপিআর এবং অন্যান্য আমস ও সার্ভিসেস-এর একা ডিভিশন গড়ে উঠবে এবং কিছুসংখ্যক নিয়মিত সৈন্য নিয়ে প্রত্যেক সেক্টরেই কোম্পানী গঠন করা হবে এবং সেই সব কোম্পানী শত্রুদের যোগাযোগ ব্যবস্থায় কমাণ্ডো এ্যাকশন চালিয়ে যাবে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট-এর পুরানা এবং নতুন ব্যাটালিয়ান নিয়ে ব্রিগেড গঠন করে সেই সব ব্রিগেড শত্রুদের ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালাবে এবং প্রয়োজন হলে দখলীকৃতাবস্থানগুলোতে প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তুলবে। যেসব যুবক পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে আমাদের কাছে এসেছে তাদেরকেও ট্রেনিং দিয়ে একটা অনিয়মিত বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। এই অনিয়মিত বাহিনী ছোট ছোট গ্রুপ এবং কোম্পানীতে বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশের ভিতরে প্রবেশ করে নিজ নিজ এলাকা শত্রুমুক্ত করবে এসব নিয়মিত বাহিনীর কোম্পানী এবং গ্রুপগুলো যাতে ভালভাবে কাজ করতে পারে সে জন্য তাদের পরিচলানার জন্য নিয়মিত বাহিনী থেকে জেসিও বা এনসিওদেরকে পরিচালনার জন্য পাঠান হবে। এই পরিকল্পনাতে আমরা আরো উল্লেখ করি যে নিয়মিত বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র পাকিস্তানী নিয়মিত বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্রের মতই হবে। কিন্তু অনিয়মিত বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র হালকা ধরনের হবে এবং এলএমজির চেয়ে ভারী অস্ত্র দেওয়ার প্রয়োজন হবে না।

 জেনারেল ওসমানী আমাদের সাথে একমত হন এবং তিনি আমাদেরকে আশ্বাস দেন যে এই পরিকল্পনা যাতে তাড়াতাড়ি কার্যকর হয় তিনি তার চেষ্টা করবেন, ইতিমধ্যে বাংলাদেশের হাজার হাজার লোক ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। অনেক যুবক আমাদের কাছে যুদ্ধ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। আমি আমার হেড কোয়ার্টারে একটা ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করে দিই। এই ট্রেনিং ক্যাম্পে বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিং-এর প্রবর্তন করি। বিশেষ করে পাক বাহিনীর যোগাযোগ ব্যাবস্থাকে বিধ্বস্ত করে দেয়ার জন্য ডেমোলিশন ট্রেনিং-এর ভার ক্যাপ্টেন হায়দর (বর্তমানে মেজর) এবং হাবিলদার মুনিরের উপর ন্যাস্ত করি। অতি সত্বরই আমার বেশ কিছু ডেমোলিশন টিম ট্রেইণ্ড হয়ে যায়। প্রথমেই আমি এসব টিমগুলোকে ঢাকা, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং কুমিল্লা-চট্টগ্রাম রেল লাইন এবং পাক সড়কে পাঠিয়ে দিই। তাদের এ কাজ দিই যে যতোটুকু সম্ভব পুল এবং রেলওয়ে লাইন ধ্বংস করে দেয়ার জন্য। এসব কাজে আমাদের সবচেয়ে বড় অসুবিধার সৃষ্টি হয় ডেমোলিশন-এর সরঞ্জামাদির অভাবে। আমরা হয়তো বারুদ পাই কিন্তু ফোটানোর জন্য ডেটোনেটোর পাই না