পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১০৭

কিংবা অন্য কোনো সরঞ্জামাদি। এসব অসুবিধার মধ্যেও আমরা প্রত্যেকটি রেল এবং রাস্তাতে বেশ কিছুসংখ্যক পুল ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হই যার ফলে পাকিস্তানীদের যোগাযোগ ব্যবস্থা- ঢাকার সঙ্গে এই সব প্রধান স্থানগুলোর- বিনষ্ট হয়ে যায় এবং পাকিস্তানকে বিমান ও জলপথের সাহায্য নিতে হয়। এই রুপ অবস্থা শেষ পর্যন্ত চলে।

 আমি আমার হেডকোয়ার্টার তেলিয়াপাড়া থেকে সরিয়ে কুমিল্লার কাছে মতিনগর নামক স্থানে স্থাপন করি। সেখান থেকে কুমিল্লা এবং ঢাকা কাছে হওয়াতে আমার পক্ষে এসব জয়গাতে গেরিলা তৎপরতা চালানো অনেক সুবিধাজনক হয়। আমার ট্রেনিং ক্যাম্প এ সময়ে অনেক বড় হয়ে যায় এবং হাজার হাজার ছেলেদের আমি ট্রেনিং দিতে শুরু করি। এসব ছেলেদের মধ্যে অনেককেই আমি নিয়মিত বাহিনীর শিক্ষা প্রদান করি। প্রথম অবস্থায় সৈন্যদের এবং অনিয়মিত বাহিনীর লোকদের থাকা খাওয়ার ও চিকিৎসার অত্যন্ত অসুবিধা হয়। আমাদের কাছে না ছিল রসদ, না ছিল টাকা পয়সা, না ছিল বাসস্থান। অনেক সময় এই সব হাজার হজার লোককে খাওয়ানোর জন্য আমাকে বাংলাদেশের ভেতর বিভিন্ন রেশন ডিপো (এলএসডি) থেকে রসদ জোরপূর্বক আনতে হয়েছিল। কোন কোন সময় রসদের ব্যবস্থা হলেও হাজার হজার লোকের খাবার তৈরীর হাড়ি পাতিল বাসনপত্র ছিল না। তেলের ড্রাম কেটে আমরা পাত্র তৈরী করে নিই। অনেক সময় এমন দিন যায় যে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মাত্র একবার ক্যাম্পের লোক খেতে পেয়েছে শুধু আধাসিদ্ধ ভাত, কোন সময় ডাল ছাড়াই। থাকার জন্য কোন আশ্রয় না তাকায় অধিকাংশ লোকজনকে বৃষ্টিতে ভিজতে হতো। কোন বিশুদ্ধ পানি ছিল না নালার পানি ব্যবহার করতে হতো। তবুও এত কষ্টের ভিতরে আমি ক্যাম্পে লোকজনের মুখে সব সময় হাসি এবং উৎফুল্ল ভাব দেখতাম। এরা সবাই নিয়মিত এবং গণবাহিনী মিলেমিশে সব প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছিল। আস্তে আস্তে অব্যবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। ভারত সরকার ইউথ ক্যাম্প তৈরী করার জন্য সাহায্য দেয়। আমি আগরতলার রিলিফ ডিপার্টমেণ্ট-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে একটা ইউথ ক্যাম্পের অনুমোদন করিয়ে নিই। তাদের কিছুটা আর্থিক সহায্যের ব্যবস্থা করি এবং আমার লোকদের প্রচেষ্টায় আমরা মেলাঘর নামক স্থানে একটা ক্যাম্প গঠন করি। এ জায়গাটা পাহাড়ের উপর এবং জঙ্গলের ভিতর বেশ একটা সুন্দর জায়গায় অবস্থিত ছিল। পাকিস্তানী হামলার আশংকা থেকেও বিপদমুক্ত ছিল। এখানেই আমি আমার স্থায়ী হেড কোয়ার্টার স্থাপন করি। এ ক্যাম্পটিতে বেশী জায়গা ছিল বলে আমি তিন চার হাজার লোককে একত্রে থাকা-খাওয়া এবং ট্রেনিং-এর বন্দোবস্ত করতে পারি। এ ক্যাম্পে আমি নিয়মিত ও গণবাহিনীর উভয় প্রকারের মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং শুরু করি। এ সময় কুমিল্লার দক্ষিণে আমার যে সব সেনাদল ছিল তাদেরকে নিয়ে একা সাবসেক্টর গঠন করি। এ সাব সেক্টর হেড কোয়ার্টার আমি নর্ভয়পুরে স্থাপন করি। ক্যাপ্টেন আকবর (বর্তমানে মেজর) লে. মাহবুব এবং লে. কবির এই সাবসেক্টর থেকে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। এখান থেকে একটি কোম্পানী সুবেদার আলি আকবর পাটোয়ারীর অধীনে লাকসামের পশ্চিমবর্তী এলাকায় তাদের গোপন ঘাঁটি স্থাপন করে এবং এখান থেকে নোয়াখালী, লাকসাম, কুমিল্লা, চাঁদপুরের রাস্তায় শত্রুসেনাদের উপর অনেক আক্রমণ চালাতে থাকে।

 জুলাই মাসে শত্রুদের একটি শক্তিশালী দল এলাকাকে মুক্তি সেনাদের হাত থেকে মুক্ত কারার জন্য লঞ্চযোগে চাঁদপুর থেকে ডাকাতিয়া নদীতে অগ্রসর হয়। সুবেদার আলী আকবর পাটোয়ারী আগে থেকে এ সম্বন্ধে খবর পেয়েছিল। সে ছাতুরার নিকট একটি সুপারির বাগানে শত্রুসেনাকে এ্যামবুশ করার জন্য প্রস্তুত ছিল। নদীর দু'পাশে হালকা মেশিনগান লাগিয়ে শত্রুদলের অপেক্ষায় ছিল। সকাল ১১ টায় শত্রুরা লঞ্চযোগে এ্যামবুশ অবস্থানের মধ্যে পৌঁছায় এবং নদীর দুই তীর থেকে আমাদের কোম্পানীর লোকেরা শত্রুসেনার উপর অতর্কিত গোলাগুলি চালায়। এতে লঞ্চের মধ্যে অনেক শত্রুসেনা হতাহত হয়। উভয় পক্ষের এ সংঘর্ষে শত্রুসেনারা পর্যুদস্ত হয়। উপায়ন্তর না দেখে শত্রুসেনারা পিছু হটে যায় এবং আবার লঞ্চ থেকে নেমে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু এবারও তারা পরাস্ত হয়ে চাঁদপুরে ফিরে যায়। এ কোম্পানী পরে চাঁদপুর থেকে কুমিল্লার বেশ কয়েকটি সেতু ও রেলসেতু ধ্বংস করে দেয় পাক বাহিনী পরবর্তী পর্যায়ে অনেকবার আমাদের এ মুক্ত এলাকাকে দখল কারার চেষ্টা করে কিন্তু তারা অসমর্থ হয় নির্ভয়পুর থেকে আমাদের সৈন্যারা এবং গেরিলা