পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১১২

গিয়ে পড়ছিল। পাশ্ববর্তী রাষ্ট্র আমাদের এ অবস্থাটি থেকে যুদ্ধ আরো চালিয়ে যাওয়ার আপত্তি করে। তাদের বিমানবন্দরে ক্ষতি হওয়ার আশংকায় এ আপত্তি করে। আমরা নিরুপায় হয়ে দেড় মাস যুদ্ধ চালানোর পর আজমপুর অবস্থান পরিত্যাগ করে সিঙ্গারবিলে নতুন অবস্থান গড়ে তুলি।

 পাক বাহিনী মাধবপুর থেকে অগ্রসর হয়ে কমলছড়ি চা বাগান দখল করে নেয়। এই চা বাগানে তারা মিলিশিয়ার এক কোম্পানী এবং নিয়মিত বাহিনীর প্লাটুনসহ একটা শাক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে তোলে। লে. হারুন বুঝতে পারে যে, পাক সেনারা আখাউড়া থেকে (দক্ষিণ থেকে) এবং মাধবপুর থেকে (উত্তর থেকে) কমলছড়ি হয়ে তার সিঙ্গারবিল পজিশনকে ঘিরে ফেলার পরিকল্পনা করছে। লে. হারুন পাক বাহিনীকে পৃথকভাবে উত্তর এবং দক্ষিণে আঘাত হানার এ পরিকল্পনা নেয়। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী কমলছড়ি চা বাগান প্রথম 'আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। জুলাই মাসে কমলছড়ি চা বাগান এবং চা বাগানে পাক বাহিনীর ঘাঁটি সম্মন্ধে সে বিস্তারিত খবরাখবর যোগাড় করে। একদিন রাত তিনটার সময় ৪র্থ বেঙ্গল-এর ১টা প্লাটুন এবং ইপিআর-এর ১টা কোম্পানী নিয়ে গোপন পথে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে কমলছড়ি পাকবাহিনীর অবস্থানের ভিতর সাহসের সাথে ঢুকে পড়ে। এ অকস্মাৎ গোপন আক্রমণ পাক সেনাদলকে হতভম্ব করে দেয়। তাদের কিছু বুঝাবার বা বাধা দেয়ার আগেই লে. হারুনের দল পাক বাহিনীর অন্তত ছয়টা ব্যাংকার গ্রেনেডের সাহায্য ধ্বংস করে দেয়। এরপর সমস্ত রাত ধরে পাক বাহিনীর সঙ্গে হাতাহাতি লড়াই চলতে থাকে। পাকিস্তানী সৈন্যরা আকস্মাৎ আক্রমণের প্রথম পর্যায়ে হকচকিত হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের মনোবল ভেঙ্গে দিয়েছিল। সে জন্য পরবর্তী পর্যায়ে যখন লে. হারুনের ছোট ছোট দলগুলি চাবাগানের সরু এবং গোপন রাস্তায় অগ্রসর হয়ে একটার পর একটা ব্যাংকার ধ্বংস করে যাচ্ছিল তখন উপায়ন্তর না দেখে পাক বাহিনীর সৈন্যরা মনোবল হারিয়ে পালিয়ে যেতে শুরু করে এবং এতে তাদের বেশ লোক গুলিতে নিহত হয়। সকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত কমলছড়ি চা বাগানটি সম্পূর্ন লে. হারুনের দখলে এসে যায়। এ যুদ্ধের ফলে পাকিস্তানিদের ৫০ জন নিহত এবং আমাদের হাতে ৪টি মেশিনগান ও ৬টি হালকা মেশিনগান, বেশ কিছু রাইফেল এবং অজস্র গোলাগুলি ও প্রচুর রসদ এবং কাপড়-চোপড় হস্তগত হয়।

 ক্যাপ্টেন গাফফার এবং ক্যাপ্টেন সালেকের নেতৃত্বে মুক্তিসেনারা মন্দভাগ এবং মালদানদীতে শত্রুসেনাদের উপর অনবরত আঘাত চলিয়ে যাচ্ছিল। ২৬শে মে রাত ৯টায় সুবেদার ভূইয়ার নেতৃত্বে দুটি সেকশন রকেট লাঞ্চার নিয়ে শত্রুর শালদানদীর পজিশনের ভিতর ঢুকে যায়। এরপর শত্রুদের ২টা ব্যাংকার তারা রকেট লাঞ্চারের সাহায্যে ধ্বংস করে দেয়। শত্রুরা তাদের উপর পাল্টা আক্রমণ চালালে পেট্রোল পার্টি হালকা মেশিন গানের সাহায্যে শত্রুসেনাদের বেশ কিছু লোক নিহত করে এবং তারা পিছু হটে আসে। পরে জানতে পারা যায় যে, এ আকস্মিক হামলায় শত্রুদের ১ জন জেসিও এবং ৯ জন সৈন্য মারা যায়। ২৮ শে মে রাতে মুক্তিবাহিনীর কমাঙ্গেরা কুমিল্লার নিকট কালিকাপুর রেলওয়ে ব্রিজ উড়িয়ে দেয়। ঐ দিনই সকালে পাকিস্তানী সেনারা কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কের কাছে রঘুরামপুরে একটি কোম্পানী নিয়ে আসে। এ কোম্পানীকে আমাদের সেনাদল সকাল সাড়ে ছটার সময় অতর্কিতে এ্যামবুশ করে এবং এ্যামবুশে পাকসেনাদের অন্তত একজন অফিসারসহ ৩৫ জন লোক হতাহত হয়। পাকসেনারা আঘাত খেয়ে মরিয়া হয়ে ভবনগর, শালুকমুডা, খাড়েরা, ফকিরবাজার প্রভৃতি গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেয়। এ ছাড়াও শত্রুসেনারা তিন ইঞ্চি মর্টার এবং ১০০ এম এম ভারী মর্টারের সাহায্যে যথেষ্টভাবে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলির উপর গোলা ছুঁড়তে থাকে।

 ২৮শে মে আর একটি পেট্রোল পার্টি নায়েক গিয়াসুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে মনোহরপুর নামক গ্রামে শত্রুদের জন্য একটি এ্যামবুশ পেতে থাকে। পাকসেনাদের ১টি কোম্পানী জঙ্গলবাড়ীর দিকে যাচ্ছিল কুমিল্লা- ব্রাহ্মণবাড়িয়া রাস্তা দিয়ে। সকাল সাড়ে ৮টায় পাকসেনাদের কোম্পানীটি নায়েক গিয়াসুদ্দিনের এ্যামবুশ-এর ফাঁদে পড়ে যায় এবং তাদের ২৫ জনের মত লোক হতাহত হয়। শত্রুসেনারা পিছু হটে এসে পুনরায় কামানের গোলার সাহায্যে আক্রমণের চেষ্টা করে। তখন আমাদের এ্যামবুশ পার্টি তাদের অবস্থান পরিত্যাগ করে। শত্রুরা