পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১২০

অমার অবস্থানের নিকটবর্তী বুড়িচং থানা আমার জন্য একটা বাধার কারণ হয়ে দাড়িয়ে ছিল। কেননা বুড়িচং এর ভিতর দিয়েই আমার গেরিলারা গোপন পথে ঢাকা কুমিল্লা এবং ফরিদপুরে যাতায়াত করত। এই থানাটির অবস্থানের গোপন পথগুলো মোটেই নিরাপদ ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশরা পাক সেনাদের খবরাখবর পাঠাত। আমি বুড়িচং থানা আক্রমন করার জন্য ১৬জনের একটি দলকে পাঠাই। ১৪ই জুন রাত ১টায় এই দলটি অতর্কিত বুড়িচং থানার উপর আক্রমন চালায়। থানায় প্রহরারত ইপকাফ এবং পুলিশ যথেষ্ট বাধা দেয়। কিন্তু অবশেষে আমাদের রেইডিং পার্টির হাতে তারা পরাস্ত হয়। এই সংঘর্ষে শত্রুদের ৮জন নিহত হয়। আমাদের ১জন লোক গুরুতরভাবে আহত এবং একজন নিখোজ হয়। এর ফলে বুড়িচং থানা শত্রুমুক্ত হয় এবং ঢাকা, কুমিল্লা যাবার গোপন পথ নিরাপদ হয়।

 ঢাকাতে ৪ঠা জুন যে দলটিকে পাঠানো হয়েছিল সেই দলটি তাদের কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে থাকে যাতে স্বাভাবিক পরিবেশ পাকিস্তানীরা ফিরিয়ে আনতে না পারে। ঢাকার প্রশাসন ব্যবস্থা যাতে পাকিস্তানীদের সম্পূর্নভাবে নিয়ন্ত্রনে না আসে তার জন্য এই গেরিলা দল তৎপর ছিল। দলটি ১০ই জুন দুপুর ২টার সময় নিউ মার্কেটের প্রধান চত্বরে তিনটি গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায়। এর ফলে সমস্ত লোকজন নিউ মার্কেট থেকে পালিয়ে যায় এবং দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। এর পরদিন বিকাল ৪টার যখন অফিস শেষ হচ্ছিল ঠিক সে সময় ওয়াপদা বিল্ডিং এর সামনে ২টি গ্রেনেড বিস্ফোরন ঘটায়। এর ফলে ওয়াপদা ভবনের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায়।

 এদিকে নয়নপুর রেল স্টেশনের নিকট গোডাউনের ভিতর শত্রুদের কিছুসংখ্যক সৈন্য তাদের ঘাটি গড়ে তুলেছিল। এই সংবাদ ৪র্থ বেঙ্গলের এ কোম্পানী জানতে পারে। মেজর সালেক একটি প্লাটুনের সঙ্গে আর আর রাইফেল ও মর্টার দিয়ে এ ঘাটিটি আক্রমনের জন্য পাঠায়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় এ দলটি শত্রুদের অবস্থানে দক্ষিণ দিক দিয়ে পিছনে অনুপ্রবেশ করে এবং অতর্কিতে ঐ গোডাউনটির উপর আক্রমন চালায়। আর আর এবং মর্টারের গোলা গোডাউনটির যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করে এবং কয়েকটি আর আর এর গোলা গোডাউনের ভিতরে পড়ে বিস্ফোরণ ঘটায়। ঐ দিন রাতেই হাবিলদার সালামের নেতৃত্বে নয়নপুরের রেলওয়ে স্টেশনের দক্ষিনে আশাবাড়ী থেকে রাত দেড়টার সময় শত্রু অবস্থানের উপর আর আর রাইফেল ও মর্টারের সাহায্যে আবার আক্রমন চালানো হয়। শত্রুরা এ আক্রমণের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না। তারা দ্বিতীয়বার আক্রমণ আশা করেনি। এ আক্রমনের ফলেও শত্রুদের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়।

 এ সময় শত্রুদের অবস্থান যেখানে যেখানে ছিল সে সব অবস্থানের কাছাকাছি এবং পাক সেনাদের চলাচলের রাস্তার উপর মাইন পুতে রাখা হয়েছিল। ১৪ই জুন রাতে ফকিরহাট রেলওয়ে স্টেশন থেকে ৭০০/৮০০ গজ উত্তরে শত্রুর একটি দল দুপুরে বখশিমাইল গ্রামে পেট্রোলিং এর জন্য গিয়েছিল। আর একটি দল গাজীপুরের নিকট আমরা যে কাঠের পুল জ্বালিয়ে দিয়েছিলাম সেটি মেরামত করছিল। বখসিমাইল গ্রাম থেকে সন্ধ্যার সময় পাক সেনাদের দলটি ফকিরহাটে নিজেদের অবস্থানে ফেরার পথে আমাদের পুতে রাখা মাইনের মধ্যে পড়ে যায় এবং মাইনগুলি তাদের পায়ের চাপে ফাটতে থাকে। এতে তাদের অনেক লোক হতাহত হয় এবং তাদের মধ্যে ভয়ংকর বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। এ মাইনগুলোর ফাটার শব্দ নিকটবর্তী অবস্থান থেকে পাকসেনারা শুনতে পায়। রাতের অন্ধকারে তারা ঠিক বুঝতে পারছিল না এ বিস্ফোরণের সঠিক কারণ কি? মুক্তিবাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে ভেবে পাক সেনারা প্রচণ্ডভাবে গোলাগুলি ছুড়তে থাকে। এই গোলাগুলি রাত ৮টা থেকে রাত ৩টা পর্যন্ত চলতে থাকে। শত্রুরা নিজেদের লোকের উপর শতে শতে মর্টার এবং কামানের গোলা ছুড়তে থাকে। আমাদের দূরে অবস্থিত পেট্রোল ইয়া আলী, ইয়া আলী, বাচাও বাচাও, প্রভৃতি ধ্বনি শুনতে পায়। পরে আমরা পাশ্ববর্তী গ্রামের লোকমুখে শুনতে পাই যে আমাদের মাইনে এবং পাক সেনাদের নিজেদের গোলাগুলিতে অন্ততপক্ষে ৪০/৫০ জন পাক সেনা হতাহত হয়েছে। পরদিন সকালে পাকসেনারা একজন ব্রিগেডিয়ার ঐ অবস্থানটি পরিদর্শন করতে কুমিল্লা থেকে আসেন।