পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১২১

 পাকসেনারা এই দুর্ঘটনার পর রাজাপুর রেলওয়ে স্টেশনের চতুর্দিকে এবং ফকিরহাট পর্যন্ত তাদের পেট্রোলিং আরো জোরদার করে। মতিনগরে অবস্থিত আমাদের কোম্পানী শত্রুদের এই কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। ১৬ই জুন সকালে আমাদের একটি প্লাটুন পাকসেনাদের পেট্রোলিং পথের উপর এ্যামবুশ পাতে। সকাল ৯টায় পাক সেনাদের একটি দল রাজাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে রওনা হয়। এই দলটি আমাদের এ্যামবুশ এর মধ্যে পড়ে যায়। অতর্কিতে আমাদের লোকেরা পাকসেনাদের উপর হালকা মেশিনগান ও অন্যান্য অস্ত্রের সাহায্যে গোলাগুলি চালায়। এই গোলাগুলিতে শত্রুদের ৮জন নিহত ও একজন আহত হয়। এছাড়া আমাদের লোকেরা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, টেলিফোন সেট, ড্রাইসেল ব্যাটারি ও আরও অন্যান্য জিনিস হস্তগত করে।

 জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমার কাছে খবর আসে যে, শত্রুদের গোলান্দাজ বাহিনীর একটি ব্যাটারি (দল) কুমিল্লা ব্রাহ্মনবাড়িয়ার সিএণ্ডবি রোড তাদের কামানের অবস্থান হিসাবে ব্যবহার করছে। পাক বাহিনীর নয়নপুর, শালদা নদী, টি, আলীর বাড়ী (কসবায়) প্রভৃতি শত্রু অবস্থানের জন্য এই কামানগুলি থেকে সাহায্যকারী গোলা নিক্ষেপ হত। এই কামানগুলির জন্য পাক বাহিনীর উপরোক্ত অবস্থানগুলির উপর আক্রমন অনেক সময় কার্যকরী করা যেত না। আমার কাছে আরও খবর আসে যে, প্রায় ১৫০ জন পাক সেনা এই কামানগুলিকে ব্যাবহার ও রক্ষনাবেক্ষন করে। এই সংবাদ পাওয়া মাত্র আমি লে. হুমায়ুন কবিরকে এই কামানের অবস্থানটি আক্রমন করে ধ্বংস করার জন্য নির্দেশ দেই। ৪০ জনের একটি দল (৪র্থ বেঙ্গলের ডি কোম্পানী) লে. হুমায়ূন কবিরের নেতৃত্বে ১৬ই জুন রাত সাড়ে ১০টায় শত্রুঅবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়। সমস্ত রাত চলার পর দলটি কুমিল্লা- ব্রাহ্মনবাড়িয়ার রাস্তার পশ্চিমে সাইদাবাদের চার মাইল উত্তরে ভোরে পৌঁছে এবং তাদের একটি গোপন অবস্থান তৈরী করে। ১৭ই জুন সমস্ত দিন এবং রাত লে. হুমায়ূন কবির তার সঙ্গে শুধু কয়েকজনকে নিয়ে পাকসেনাদের সাইদাবাদ অবস্থানটি সম্পূর্ণরূপে অনুসন্ধান করে। এই অবস্থানটি পাহারার কি কি ব্যবস্থা আছে, কারা পাহারাদার এবং কি কি অস্ত্রের সাহায্য পাহারা দেয়, অবস্থানটিতে পৌঁছার জন্য গোপন পথ কি, কামানগুলি রাতে কোন স্থানে রাখে, কোন সময়ে পাক সেনারা বেশী সজাগ এবং তাদের বাংকারগুলির অবস্থান কোথায় প্রভৃতি খবরাখবর সে সংগ্রহ করে। এরপর লে. হুমায়ুন কবির সকাল হবার আগেই তার গোপন ঘাটিতে ফেরত আসে। ১৮ই জুন সমস্ত দিন তার দলটিকে পাকসেনাদের সম্বন্ধে বিস্তারিত খবর বলে এবং পাক ঘাটিতে আক্রমণের পরিকল্পনা এবং কার্যাবলী সম্বন্ধে প্রত্যেককে বুঝিয়ে দেয়। সমস্ত দিন দলটি আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নেয়।

 ১৮ই জুন ভোর চারটায় লে. হুমায়ুনের নেতৃত্বে আমাদের দলটি পাক সেনাদের কামান ঘাঁটির উপর পিছন দিক থেকে অনুপ্রবেশ করে অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। পাক সেনারা তাবুর মধ্যে শুয়ে ছিল। তারা এ আক্রমণের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না। সেদিনই কুমিল্লা থেকে পাক সেনাদের দুটি কোম্পানী যেগুলি সামনে শত্রুদের ঘাটিকে শক্তিশালী করার জন্য যাচ্ছিল তারাও রাতের বিশ্রামের জন্য অসতর্কভাবে এ অবস্থানটিতে শুয়ে ছিল। আমাদের দলের অতর্কিত আক্রমণে পাকসোনাদের ঘাটিতে ভীষণ বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় এবং অনেক শত্রুসেনা আমাদের গুলিতে প্রান হারাতে থাকে। আমাদের লোকেরা কয়েকটি জীপ ও ৩টনের ট্রাকে গ্রেনেড ছুড়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। পাকসেনারা এত বেশী ভীত হয়ে পড়ে যে তারা তাদের হেড কোয়ার্টারে জঙ্গী বিমানের সাহায্যের প্রার্থনা জানায়। যুদ্ধ বেশ কিছুক্ষণ ভয়ংকরভাবে চলে এবং আমাদের সৈন্যরা কামান, গাড়ি ইত্যাদি ধ্বংস করে। কিন্তু ইতিমধ্যে সকাল হয়ে যায় এবং শত্রুদের প্রতিরোধ শক্তি বাড়তে থাকে ও তাদের আবেদনে তিনটি জঙ্গী বিমান ঘটনাস্থলে পৌঁছে আমাদের রেইডিং পার্টির উপর আক্রমন চালায়। লে. হুমায়ূনের দলটি তখন আটকা পড়ে যাবার ভয়ে আক্রমণ শেষ করে গ্রামের গোপন পথে মেঘনার দিকে পশ্চাদপসরণ করে। এই পশ্চাদপসরনের সময় তারা বার বার পাকিস্তানী জঙ্গী বিমান দ্বারা আক্রান্ত হয়। তবুও সমস্ত বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে তারা সাফল্যের সাথে শত্রদের আওতার বাইরে চলে আসে। একদিন পর তারা অন্য পথে আবার কুমিল্লা ব্রাহ্মনবাড়িয়া প্রধান সড়কের উপর আসে এবং মতুরা সড়কের সেতুটি উড়িয়ে দিয়ে নিজ ঘাটিতে নিরাপদে ফিরে আসে।