পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ নবম খন্ড

দলিল প্রসঙ্গঃ সশস্ত্র সংগ্রাম (১)

 সশস্ত্র সংগ্রামের দলিলপত্র তিন খণ্ডে বিভক্ত করা হয়েছে। দীর্ঘ নয় মাস স্থায়ী এই যুদ্ধের প্রকৃতি বিচার করে বিভাজনগুলি করা হয়েছে।

 প্রথশ ভাগে এসেছে প্রতিরোধ যুদ্ধের বিবরণ, যেহেতু মার্চ থেকে মে-জুন পর্যন্ত এর ধরন ছিল প্রতিরোধমূলক। দ্বিতীয় ভাগে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কেন্দ্রীয় কমাণ্ডের অধীনে সংঘটিত যুদ্ধের ঘটনাবলী (মধ্য ডিসেম্বরে হানাদার বাহিনীর চূড়ান্ত আত্মসমর্পণ পর্যন্ত)। তৃতীয় ভাগে রয়েছে সরকারী দলিলপত্রের সংকলন।

 বর্তমান খণ্ড সশস্ত্র সংগ্রাম (১) প্রাণীত হয়েছে প্রাথমিক প্রতিরোধ যুদ্ধে ঘটনাবলী নিয়ে। প্রতিরোধ যুদ্ধ যেহেতু ছিল সারাদেশে বিস্তৃত, সেহেতু এ সংক্রান্ত যাবতীয় বিবরণ জেলাওয়ারীভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে।

 মার্চ মাসের ব্যাপক গণ-অসহযোগের মূল কেন্দ্র ঢাকায় হানাদার বাহিনীর আকস্মিক আক্রমণ এবং সশস্ত্র বাঙালী সেনা ইউনিটগুলিকে নিরস্ত্রকরণ ও বাঙালী সেনা নিধন, ছাত্রাবাস আক্রমণ, বুদ্ধিজীবী ও নিরস্ত্র জনগণকে অবাধে হত্যার (পৃঃ ৫-৬, ৬-৭, ১১-১৩, ১৪-১৯, ৩২-৪১) তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় দেশের সর্বত্র সশস্ত্র বাঙালী ইউনিটসমূহ- ইস্ট বেংগল রেজিমেণ্ট, ই-পি-আর (বর্তমানে বি-ডি-আর), পুলিশ প্রভৃতি রুখে দাঁড়ায়। যেসব স্থানে এসব সশস্ত্র ইউনিট অবস্থান করছিল সেসব স্থানে ব্যাপক গণ-অসহযোগের পটভূমিতে তাদের এই তাৎপরতা জনগণের স্বতোৎসারিত দৃঢ় সক্রিয় সমর্থনে প্রবল প্রতিরোধ যুদ্ধে পরিণত হয়। পরবর্তীকালে তা বিজয় অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত হিসেবে কাজ করে।

 প্রাথমিকভাবে এ যুদ্ধ ছিল অসংগঠিত, উপস্থিত স্থানীয় নেতৃত্বনির্ভর এবং অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র সজ্জিত একটি প্রবল শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রায় নিরস্ত্র জনতার আত্মরক্ষার মরিয়া প্রয়াস-সঞ্জাত এক অসম লড়াই। অনিবার্যরূপে এ ছিল সশস্ত্র সংগ্রামের এক খণ্ডিত পর্যায়। এ যুদ্ধে প্রতিরোধী শক্তির প্রাথমিক পরাজয় ঘটা সত্ত্বেও তাদের ত্যাগ, বীরত্ব ও অসমসাহসিকতার অত্যুজ্জ্বল নিদর্শনাবলী গভীর প্রেরণার উৎস ছিল। এ সংক্রান্ত গটনাবলীর বিন্যাস দেশর তৎকালীন প্রশাসনিক-রাজনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ডের মূল কেন্দ্র ঢাকা থেকে শুরু করা হয়েছে এবং পরে পৃথক পৃথক শিরোনামে প্রত্যেক জেলার ঘটনা পরপর তুলে ধরা হয়েছে। এ বিন্যাসে দেশর তৎকালীন ক্যাণ্টনমেণ্টগুলিতে অবস্থানরত ইস্ট বেংগল রেজিমেণ্টগুলির বিভিন্ন ব্যাটালিয়ন, যেমন ১ম বেংগল, ২য় বেংগল, ৩য় বেংগল, ৪র্থ বেংগল ও ৮ম বেংগলের ভূমিকা এবং তাদের অফিসারদের দৃঢ় সিদ্ধান্ত ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠার কথা যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে আধাসামরিক বাহিনী ই-পি-আর উইংগুলির সময়োচিত নেতৃবৃন্দ, ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের লক্ষ্যে দৃঢ়ভাবে একীভূত বীরত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডের বিবরণ। সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধ যুদ্ধকে সুসংহত করার লক্ষ্যে মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এবং তৎকালীন কর্নেল (অবঃ) এম. এ. জি. ওসমানীকে সর্বাধিনায়ক করে মুক্তিবাহিনী গঠনের বিষয়ও বিবরণে এসেছে (পৃঃ ১২৪, ২৪৫-২৪৭, ২৫৮-২৬১)।

 প্রতিরোধ যুদ্ধের বিবরণ সংবলিত দলিলপত্র সংগ্রহ ও সন্নিবেশ করা মোটেও সহজসাধ্য ব্যাপার ছিল না। হানাদার বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের শিকার হয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনার বিবরণ রাখতে সমর্থ হননি। এ বিষয়ে তাই স্বাধীনতা যুদ্ধের উত্তরকালে এ যুদ্ধের সাথে জড়িত বিভিন্ন সামরিক ও বেসামরিক নেতৃবৃন্দ্রে সাক্ষাৎকারসমূহের উপরই নির্ভর করতে হয়েছে মুখ্যভাবে। এছাড়া সমসময়ে প্রণীত ‘প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ’ এ ব্যাপারে মূল্যবান আকর গ্রন্থ রূপে কাজ করেছে। পরবর্তীতে রচিত আরও কিছু গ্রন্থ, যেমন ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’, ‘মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস' প্রভৃতি তথ্যে ও সত্যে প্রতিরোধ যুদ্ধকে উজ্জ্বলতর করে তুলেছে (পৃঃ ৪৬-৪৯, ৫৭-৮৯, ২৬১)। পত্র-পত্রিকার বিবরণও সশস্ত্র প্রতিরোধের পরিস্থিতিকে তুলে ধরতে