পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১২৭

 জুন মাসে প্রথম সপ্তাহে আমার হেডকোয়ার্টার থেকে গেরিলাদের ৬০জনের একটি দলকে আমি ফরিদপুরে পাঠাই। মাদারীপুর, পালং, রাজৈর, নড়িয়া প্রভুতি থানায় গেরিলাদের বিভিন্নভাবে বিভক্ত করে দেয়া হয়েছিল। এই দলগুলি তাদের নিজ নিজ এলাকায় গিয়েয় ঘাটি গড়ে তোলে। এরপর তারা কিছুসংখ্যক পাকিস্তানী দালালকে হত্যা করে। এরপর তারা নিজ নিজ এলাকার থানাগুলি যেখান থেকে দালাল পুলিশরা পাকিস্তানীদের খবরাখবর যোগাত, সেই থানাগুলি ভালভাবে রেকি করে। প্রথমে তারা শিবচর অয়ারলেস স্টেশনটি ধ্বংস করে দেয়। এরপর গেরিলা কমাণ্ডার খলিলের নেতৃত্বে পালং থানার উপর ২৭শে জুন রাত ১১টার সময় আক্রমণ চালান হয়। এ আক্রমনে একজন দালাল সাব ইন্সপেক্টর ও দুজন পুলিশ নিহত হয়। গেরিলারা ৯টা রাইফেল দখল করে নেয়। তারা থানার অয়ারলেস স্টেশনটিও ধ্বংস করে দেয়। নড়িয়ার গেরিলাদল খবর পায় যে, মাদারীপুরের ডিআইবি ইন্সপেক্টর ও দালাল সি আই পুলিশ একটি স্থানীয় দালালের বাড়িতে গুপ্ত আলোচনায় ব্যস্ত। এ সংবাদ পেয়ে তারা সেখানে উপস্থিত হয়ে তাদের উপর আক্রমন চালায়। তারপরে নড়িয়ার অয়ারলেস স্টেশনটিও ধ্বংস করে দেয়। নড়িয়ার গেরিলাদল খবর পায় যে, মাদারীপুরের ডিআইবি ইন্সপেক্টর ও দালাল সি আই পুলিশ একটি স্থানীয় দালালের বাড়িতে গুপ্ত আলোচনায় ব্যাস্ত। এ সংবাদ পেয়ে তারা সেখানে উপস্থিত হয়ে তাদের উপর আক্রমণ চালায়। তারপরে নড়িয়ার অয়ারলেস স্টেশনটিও ধ্বংস করে দেয়।

 শত্রুদের একটি ছোট দল রাজৈর থানার টাহেরহাটে এসে অবস্থান নেয়। রাজৈরের গেরিলা দলটি তাদের অবস্থানটি সম্বন্ধে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে খবর নেয়। ২৮শে জুন রাত ১১টার সময় ২০জনের একটি গেরিলাদল টাহেরহাটে পাকসেনাদের অবস্থানের উপর অতর্কিত আক্রমণ করে। এ আক্রমণের ফলে পাকসেনাদের ১০জন নিহত হয় এবং পাকসেনারা টাহেরহাট অবস্থান থেকে পালিয়ে যায়।

 পাকিস্তান রেডিও থেকে ঘোষণা করা হয় যে ২৮শে জুন সন্ধ্যায় জেনারেল মোঃ ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেবেন এ সংবাদ জানতে পেরে আমি ইয়াহিয়া খানের ভাষণকে উপস্থিত সম্বর্ধনা জানানোর জন্য একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করি। এসম্বন্ধে আমি আমার সাবসেক্টর কমাণ্ডারদের আমার হেডকোয়ার্টার এ ডেকে পাঠাই এবং তাদের সঙ্গে আলোচনা করি। আলোচনার পর এ সিদ্ধান্তে পৌছি যে ভাষণের সময় পাকিস্তানীরা সর্বক্ষেত্রেই রেডিও শোনার জন্য তাদের নিজ নিজ প্রতিরক্ষা অবস্থানে একত্রিত হবে এবং সতর্কতামূলক ব্যবস্থা কিছুটা শিখিল হবে। এ সময় তাদের এ সতর্কতা আমাদের জন্য আনবে এক সুবর্ন সুযোগ। তাছাড়া আমাদের এ্যাকশনও হবে ইয়াহিয়া খানের ভাষণের সমুচিত জবাব। এ জন্য আমি সব সাব সেক্টর কমাণ্ডারকে নির্দেশ দিলাম, তারা সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার পর থেকে যখন ইয়াহিয়ার ভাষন আরম্ভ হবে, ঠিক সে সময়ে আমার সেক্টরের সব এলাকায় একযোগে পাকসেনাদের ওপর তীব্র আক্রমণ চালাবে। এ নির্দেশ অনুযায়ী ৪র্থ বেঙ্গলের এ কোম্পানী ন্যানপুরের পাকসেনাদের অবস্থানের দিকে তিন দিক থেকে অগ্রসর হয় এবং ভাষণ আরম্ভ হবার কিছুক্ষণ পরেই পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালায়। পাকসেনারা এ অতর্কিত আক্রমণে হকচকিত হয়ে যায়। এর সাথে সাথে আমাদের মর্টারের গোলা তাদের উপর পড়তে থাকে। পাকসেনারা তাদের অবস্থানের চুতুর্দিকে দৌড়াদৌড়ী এবং চীৎকার করে বাংকারের দিকে যাবার চেষ্টা করে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মেশিনগানের গুলিতে তাদের অনেকেই মারা যায়। আধ ঘণ্টা এভাবে গুলী চালানোর পর আমাদের সৈন্যরা শত্রু অবস্থান পরিত্যাগ করে নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরে আসে। এ যুদ্ধে ১৮জন নিহত এবং বহু আহত হয়।

 ঐ দিনই আমাদের একটি কোম্পানী মর্টারসহ লেঃ হুমায়ূন কবিরের নেতৃত্বে ঠিক ঐ সময় লাটুমুড়াতে শত্রু অবস্থানের উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণের ফলে শত্রুদের মধ্যে বেশ বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়, তখন তারা ইয়াহিয়ার ভাষণ শুনছিল। এ আক্রমণের ফলে পাকসেনাদের ৫জন নিহত ও ১০জন আহত হয়। আমাদের কোম্পানী শত্রুদের উপর আড়াই ঘণ্টা আক্রমণ চালিয়ে নিরাপদে পিছু হটে আসে।

 ঢাকাতে ঐ সময়টিকে উদযাপন করার জন্য আমি ৫০জন গেরিলার একটি দলকে পাঠিয়ে দিই। এই দলটি ২৭শে জুন ঢাকায় পৌঁছে। তারপর ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ঢাকা শহরের প্রধান স্থানগুলিতে যেমন জিন্নাহ এভিনিউ মতিঝিল, শাহবাগ, পুরানা পল্টন, সদরঘাট, চকবাজার প্রভৃতি স্থানে একযোগে সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া খানের ভাষণের সময় গ্রেনেড বিস্ফোরণ এবং মোটরগাড়ীতে এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে পাকসেনারা