পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১৫৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৩০

 এই সন্দেহ এবং অবিশ্বাস সৃষ্টি হবার পর আমার কোম্পানী এবং মেজর সাদেক নেওয়াজের কোম্পানীর উদ্বৃত্ত অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে আনা হয়।

 ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আমরা ওয়াপদা কলোনী সংলগ্ন স্থানে তাঁবুতে দুই কোম্পানী থাকি। আমার আশংকা ছিল, এই দুই কোম্পানী সৈন্যকে পশ্চিম পাকিস্তানীরা অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে অস্ত্র সমর্পণ করতে বাধ্য করবে। এই সম্ভাব্য আক্রমণকে প্রতিহত করার জন্য আমি আমার কোম্পানীর এবং সাদেক নেওয়াজের কোম্পানীর জেসিওদের নির্দেশ দিই, যেন তারা আত্মরক্ষার জন্য আমাদের ক্যাম্পের চারিদিকে পরিখা খনন করে রাখে। আর যদি প্রয়োজন হয় তবে ঐসব পরিখা থেকে আক্রমণ প্রতিহত করা যেতে পারে।

 আমার এই সমস্ত কাজ খুব সাবধানে ও হুঁশিয়ারের সাথে করতে হয়। কেননা, মেজর সাদেক নেওয়াজ সব সময় আমাকে চোখে চোখে রাখতো। সে প্রায়ই আমাকে জিজ্ঞেস করত, পরিখা খনন করা, পজিশন নেয়া- এগুলোর উদ্দেশ্য কি? আমি বলতাম, ডিগিং প্র্যাকটিস এবং পজিশন নেয়ার প্রশিক্ষণ রিভাইজ করা হচ্ছে।

 ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আত্মরক্ষামূলক বিভিন্ন কাজ, এবং বিভিন্ন জেসিওদের সাথে যোগাযোগ, প্রভাবান্বিত করা, এবং সতর্ক করার কাজে লেফটেন্যাণ্ট হারুন আমাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেন। সে এসব কাজে উৎসাহী ছিল এবং অন্যান্য লোকদের প্রেরণা যোগাতো।

 প্রসঙ্গত: উল্লেখযোগ্য যে কুমিল্লার সাথে আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া ক্যাম্পের যোগাযোগ ছিল একমাত্র টেলিফোনের মাধ্যমে এবং একটি সিগন্যাল সেট যেটা অস্বাভাবিকবাবে কুমিল্লা ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের সাথে যোগাযোগ রাখত। এ সময় আমি খুব অস্বস্তিকর পরিবেশে ছিলাম। আমি সবসময় চিন্তা করতাম যে কুমিল্লাতে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এবং সৈনিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

 ২৪শে মার্চ সন্ধায় আমরা দেখতে পেলাম কুমিল্লার দিক থেকে ৮টা গাড়ির আলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে আসছে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের ক্যাম্পের প্রটেকশন পার্টি পরিখাতে অবস্থান নেয়। গাড়ি কাছাকাছি আসার পর বুঝতে পারি, মেজর খালেদ মোশাররফ তার কোম্পানী নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ১২০ মাইল দূরে সমশেরনগরে নকাশালপন্থী এবং ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের অশুভ তৎপরতা বন্ধ করার জন্য আসছে। এখানে বলে রাখা দরকার যে, মেজর খালেদ মোশাররফ যিনি আমার থেকে বাঙ্গলীদের মধ্যে সিনিয়র সেদিনই ব্যাটালিয়নে ঢাকা থেকে এসে যোগদান করেন এবং একই দিনে তাঁকে কুমিল্লা থেকে ১৭০ মাইল দূরে সমশেরনগরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এরপর চতুর্থ বেঙ্গলের একটি রাইফেল কোম্পানী আর হেডকোয়ার্টার কোম্পানী কুমিল্লা থেকে যায়।

 সেই রাতে মেজর খালেদ মোশাররফ লেঃ মাহবুবকে সঙ্গে নিয়ে আসেন এবং তার কোম্পানী আমাদের ক্যাম্পে থাকে। মেজর সাদেক নেওয়াজের সর্বক্ষণিক উপস্থিতির জন্য আমরা খোলাখুলি আলাপ - আলোচনা করতে পারি নাই। শুধু আভাষে, ইঙ্গিতে এটুকু বুঝাতে সক্ষম হই, যে কোনো পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে আমরা প্রস্তুত। সত্যি কথা বলতে কি, সেদিন আমি আর লেফটেন্যাণ্ট হারুন খুব খুশী হই এই ভেবে যে, আমাদের পরিচালনার জন্য একজন পুরোনো অভিজ্ঞ অফিসার চতুর্থ বেঙ্গলে যোগ দিয়ে কুমিল্লা থেকে আরো একটি কোম্পানীকে মরণ ফাঁদ থেকে কনফ্রনটেশনের আগেই বের করে নিয়ে এসেছেন।

 মেজর খালেদ মোশাররফের নিকট একটা সিগনাল সেট ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার দিয়ে দেয়। আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে আমার সেট এবং খালেদ মোশাররফের সেট যেন একই প্রিকুয়েন্সিতে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়। ২৪/২৫ তারিখ সকালে তিনি তার কোম্পানী নিয়ে সমশেরনগরের দিকে রওয়ানা হয়ে যান।