পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৩৪

কুমিল্লা- নোয়াখালীতে সশস্ত্র প্রতিরোধ

সাক্ষাৎকারঃ মেজর গাফ্ফার[১]

২১-৮-১৯৭৩

 আমি মনে করছিলাম কুমিল্লা ব্রিগেডের ইকবাল মোঃ শফি আমাদের ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টকে বিভক্ত এবং দুর্বল করে দিয়ে ধ্বংস করে দেবে। সেহেতু ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টের তিনটি কোম্পানীকে বাইরে পাঠিয়ে সিলেটে অবস্থানরত ৩১ তম পাঞ্জাব রেজিমেণ্ট, কুমিল্লা ক্যাণ্টনমেণ্টে অবস্থানরত ২৪তম ফ্রণ্টিয়ার ফোর্স- এর ৩ কমাণ্ডো ব্যাটালিয়ন দিয়ে আক্রমণ ও ঘেরাও করিয়ে ধ্বংস করাই তারা শ্রেয় ভেবেছিল। তারা এ কাজ ভালভাবেই সম্পন্ন করেছিল, কিন্তু আল্লাহর রহমতে তাদের পরিকল্পনা সফল হয়নি। এ পরিস্থিতিতে কুমিল্লা ক্যাণ্টনমেণ্ট ছেড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে গিয়ে অন্যান্য কোম্পানীর সাথে যোগ দেয়া শ্রেয় মনে করি। আমি ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টের প্রথম কমাণ্ড লেঃ কর্নেল খিজির হায়াতকে বুঝতে থাকি ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে গিয়ে অন্যান্য কোম্পানীর সাথে মিলিত হবার জন্য। তিনি খুব ভালো লোক ছিলেন এবং আমাকে খুব বিশ্বাস করতেন। তিনি আমার কথায় কনভিন্সড হন এবং নির্দেশ নেবার জন্য ব্রিগেড কমাণ্ডারের কাছে যান। ব্রিগেড কমাণ্ডার তাঁকে তাঁর বাহিনী নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাবার নির্দেশ দেন। লেঃ কর্নেল খিজির হায়াত ফোনে আমাকে ২৩শে মার্চ ১টার মধ্যে বাকী কোম্পানী নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাবার জন্য প্রস্তুত হতে বলেন। আমি দ্রুততার সঙ্গে ৩০টি ৩টনের গাড়িতে বেশী পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্র এবং অতিরিক্ত লোক নিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হই। আমি ১টা প্লাটুন জাঙ্গালিয়াতে রেখে যাই এবং আরেকটা প্লাটুনকে ভিতরে রেখে যাই ক্যাণ্টনমেণ্টে অবস্থানরত বাঙ্গালী অফিসারদের পরিবার- পরিজনের প্রতি খেয়াল রাখার জন্য। আমরা আমাদের পরিবার- পরিজনকে নিরাপদ জায়গায় সরাতে পারিনি, কেননা এটা করলে আমাদের উপর তাদের সন্দেহ হত এবং আমাদের পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যেত। যাবার আগে ক্যাপ্টেন উদ্দিনের (বর্তমান মেজর) সাথে কথা বলি এবং তাঁকে অনুরোধ করি আমাদের পরিবারগুলির প্রতি খেয়াল রাখার জন্য এবং পারলে নিরাপদ জায়গায় যেন সরিয়ে দেন। ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনকে সে সময় চট্টগ্রামে নবম বেঙ্গল রেজিমেণ্টে বদলী করা হয়েছিল। আমরা তাঁকে ক্যাণ্টনমেণ্টে রেখে যাই। ২৭শে মার্চ শত্রুরা কুমিল্লা ক্যাণ্টনমেণ্টে আমাদের পরিবারদের গ্রেফতার করে এবং তাদের উপর অমানুষিক অত্যাচার চালায়। ১০ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী কুমিল্লা ক্যাণ্টনমেণ্ট ঘিরে ফেলল শত্রুরা তাদের ছেড়ে দেয়। ২৮শে মার্চ ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন কুমিল্লা ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে পালিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমাদের সাথে এসে যোগ দেন।

 ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আসার জন্য আমি লেঃ কর্নেল খিজির হায়াতকে নির্দেশ দেবার অনুরোধ করি। তিনি আমার কথামত সবাইকে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়াতে আসার নির্দেশ দেন। একমাত্র সমশেরনগরে অবস্থিত মেজর খালেদ মোশাররফের বাহিনী ছাড়া সবাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসে।

 ২৪শে মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এম- সি- এ জনাব লুৎফুল হাই আমার সঙ্গে দেখা করে জানতে চান আমরা কি করব। আমি তাঁকে বলি ‘ঠিক সময়ে আমরা আমাদের কর্তব্য সাধন করব।' তিনি চলে যাবার পর আমাদের ব্যাটালিয়নের পাঞ্জাবী অফিসাররা এসে জিজ্ঞেস করে লুৎফুল হাই কেন এসেছিল। আমি তাদের বলি, সে আমার আত্মীয় এবং আমার সাথে এমনি দেখা করতে এসেছে। মিথ্যা বলে তাদের সন্দেহ দূর করি। আমি মেজর শাফায়াত জামিলকে সমস্ত পরিকল্পনার কথা বলি। সেভাবেই তিনি সমস্ত বাঙ্গালী অফিসার, জে-সি- ও এবং এন- সি- ওদের নিয়ে একটা সভা ডেকে বলেন, পরিস্থিতি খুব খারাপ- সেহেতু সবাইকে সজাগ এবং প্রস্তুত থাকতে হবে। ২৫শে মার্চ রাতে আমি মেজর খালেদ মোশাররফের সাথে অয়ারলেসে কথা বলি এবং সমস্ত পরিস্থিতি


  1. ১৯৭১ সালে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্টের হিসাবে ক্যাপ্টেন পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সাক্ষাৎকারটি বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র থেকে সংকলিত।