পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১৬১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৩৬

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসে তিনি আমাদের সাথে যোগ দেন। আমরা সে সময় বিরাট এলাকা কোম্পানীগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে সিলেটের খোয়াই নদী পর্যন্ত শত্রুমুক্ত ও স্বাধীন রেখেছিলাম।

 ৭ই এপ্রিলে এক দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। আমি ভেবেছিলাম, শত্রুরা বড় নৌকা ও লঞ্চের সাহায্যে পালাবার চেষ্টা করবে। সেহেতু আমি সমস্ত নৌকা তল্লাশি করার নির্দেশ দিই। অতি প্রত্যুষ্য ১টা মটর লঞ্চ আশুগঞ্জের দিকে যাচ্ছিল। আমি তাদের থামতে বলি। লঞ্চটি না থেমে বরঞ্চ আরও দ্রুত গতিতে চলতে থাকে। ওর ভিতর পাঞ্জাবী সেন্য আছে ধরে নিয়ে আমরা এম-এম জিও ৭৫ এম-এম-আর-আর-এর সাহায্যে গুলি ছুড়তে থাকি। লঞ্চটি থেমে যায় এবং আশ্চর্যের বেপার লঞ্চটি বেসামরিক ব্যক্তিদের দ্বারা ভর্তি দেখলাম। একজন এতে আহত হয় ও তার প্রাথমিক চিকিৎসা করে সারেংকে সাবধান করে ছেড়ে দিই। এই সময় পাক বিমান আমাদের উপর অকস্মাৎ হামলা শুরু করে দেয়।

 ৩/৪ দিন পর ক্যাপ্টেন মতিন (বর্তমান মেজর) ১টি কোম্পানী নিয়ে এসে আমাদের অব্যাহতি দেন। আমি আমার বাহিনী নিয়ে তেলিয়াপাড়া যাই পরবর্তী নির্দেশ দেওয়া হয়। দুইদিন বিবিরবাজারে অবস্থানের পর তৃতীয় দিনে ৪র্থ বেঙ্গলের ‘সি’ কোম্পানীকে নিয়ে মনতলি যাবার নির্দেশ দেন মেজর খালেদ মোশাররফ।

 ১৪ই এপ্রিল প্রথম সাফল্যজনক আক্রমণ চালাই শত্রুর বিরুদ্ধে। ঐদিন রাতে গঙ্গাসাগরে ৪টা প্লাটুনও ১টা ৩ ইঞ্চি মর্টার সেকশনের সাহায্যে শত্রু অবস্থানকে ঘিরে আক্রমণ চালাই। মেজর খালেদ মোশাররফ মর্টার সেকশনে নেতৃত্ব দেন। তাঁর অবস্থিতি আমার সৈন্যদের মনোবল বাড়িয়ে তোলে। রাত ২টার সময় শত্রুদের উপর আক্রমণ চালিয়ে ৩১ জন শত্রু সৈন্য ও ১৫/২০ জনকে আহত করি। আমরা সবাই নিরাপদে ফি আসি। ২ জন সামান্য আহত হয়।

 চারদিন সেখানে অবস্থানের পর আমাকে কসবো-শালদানদী এলাকায় যেতে বলা হয়। ১৮ই এপ্রিল আমি কসবার পথে রওনা হই এবং সেখানে ঘাঁটি গড়ে তুলি। গঙ্গাসাগরে শত্রুদের মার দেবার পর কসবা- শালদানদীর গুরুত্ব বেড়ে গিয়েছিল। আমার পৌঁছতে একটু দেরী হয়। এর আগেই শত্রুরা কসবা বাজার ও কসবা রেলওয়ে স্টেশনে ঘাঁটি গেড়ে ফেলেছে। আমি আমার ক্যাম্প ইয়াকুবপুর জামুরা এলাকায় স্থাপন করি। আমি রেকি করে বুঝতে পারি আমার অবস্থান খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। ভারতে আশ্রয় না নিয়ে নিজ অবস্থানে থেকে শত্রুদের গতিবিধি লক্ষ্য করতে থাকি। পাকসেনারা কসবা এসে নিরীহ জনসাধারণের উপর অত্যাচার, লুণ্টন, ধর্ষণ চালাতে থাকে। ইতিমধ্যে হাজার হাজার লোক পাকসেনাদের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচবার জন্য সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যাচ্ছিল।

 ১৮ই এপ্রিলের রাতেই আমি কসবা বাজার ও কসবা রেলওয়ে স্টেশন আক্রমণ করার পকিল্পনা করি। ৩ ইঞ্চি মর্টারের সাহায্যে হঠাৎ করে শত্রুদের উপর আক্রমণ শুরু করে দিই। শত্রুরা যেহেতু প্রস্তুত ছিল না, সেহেতু তারা এ আক্রমণে হকচকিত হয়ে পড়ে। এ অপ্রত্যাশিত যুদ্ধ দেড় ঘণ্টা ধরে চলে এবং এর সাফল্য অপ্রত্যাশিত ছিল। শত্রুরা তখন পর্যন্ত কোন বাঙ্কার তৈরি করেনি। ফলে তারা গাড়ি বোঝাই অস্ত্র ফেলে রেখে বাজারের কুঁড়েঘর এবং দোকানে গিয়ে আশ্রয় নেয়।

 রাত সাড়ে চারটাকে আবার আক্রমণ করার সময় হিসাবে বেছে নিই। আমি একটা লম্বা গাছের উপরে উঠে শত্রুদের অবস্থান দেকে নিই এবং আমার সৈন্যদের প্লাটুনে ভাগ করে তিন দিক দিয়ে ঘিরে ফেলি। একটি মাত্র পথ শত্রুদের জন্য খোলা থাকে। ৩.৫ ইঞ্চি রকেট লাঞ্চার এবং ছোট অস্ত্র ও মর্টারের সাহায্যে শত্রুদের উপর গোলাগুলী ছুড়তে থাকি। এই গোলাবর্ষণের ফলে শত্রুদের ৭টা গাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। ৪৫/৫০ জন নিহত এবং ৭০/৮০ জন পাকসেনা আহত হয়। শত্রুরা এ আকস্মিক আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে কসবা ছেড়ে আড়াইবাড়ি কুটির