পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৪৩

সকল প্রকার অস্ত্র সরবরাহ করারও প্রতিশ্রুতি দেন। ফেনী থেকে ফিরে বেঙ্গল রেজিমেণ্ট, ইপি-আর এবং ৭৬ জন প্রকৃত নিয়মিত সৈন্য সংগ্রহ করি ও নোয়াখালীতে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা করি।

 ৪ঠা এপ্রিল, ১৯৭১-সর্বপ্রথম বাঘমারা পরিদর্শনঃ দয়াময়কে স্মরণ করে সর্বপ্রথমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য লাকসামের উত্তরে বাঘমারা পরিদর্শন করি এবং সুবেদার নজরুল ও সুবেদা জব্বারকে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার স্থান নির্দিষ্ট করে দিই। এমন সময় নোয়াখালী জেলার ডেপুটি কমিশনার সাহেব এবং পরিষদ সদস্যগণ এসে আমাকে জানালেন যে, দু'খানা পাকসেনা বহনকারী জাহাজ রামগতির দক্ষিণ পাশের নদীতে অবস্থান করছে। এ খবর শোনার পর আমি তৎক্ষণাৎ রুহুল আমীন (শহীদ), পিটি-অফিসার সাহেবসহ চারজন বুদ্ধিমান জোয়ানকে তার সত্যতা প্রামণ করতে উক্ত নদীতে পাঠালাম। তাঁরা নদী থেকে ফিরে এসে আমাকে নিশ্চয়তা দিয়ে জনান যে, সেখানে একখানা নৌকা ব্যতীত অন্য কিছুই নেই। অতঃপর ৫ই এপ্রিল নোয়াখালীর অদূরবর্তী দৌলতগঞ্জের সেতুটি ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নিই। কেননা পাক সৈন্যরা তখন লাকসামের উত্তরে বাঘমারাতে অবস্থান করছিল। কয়েকজন মোজাহিদ ও আনসারকে হালকা অস্ত্র দিয়ে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করি। বিকেলে অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ফেনীতে যাই।

 ৬ই এপ্রিল, ১৯৭১: ফেনী থানা থেকে অতিকষ্টে ১৮ টি হ্যাণ্ড গ্রেনেড সংগ্রহ করে কোম্পানীতে ফিরে আসি। এক'দিনে রাতদিনের আরাম-আয়েশ হারাম হয়ে পড়ে আমার জন্য। শুধু যোদ্ধা, অস্ত্র আর এ্যামুনিশন সংগ্রহের চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ি। য সমস্ত যোদ্ধা আমার সাথে ছিল তাদের হাইড-আউটের কথাও চিন্তা করি।

 ৭ই এপ্রিল, ১৯৭১: সারারাত যোদ্ধা, হাতিয়ার আর এ্যামুনিশন সংগ্রহের উদ্দেশ্যে হাঁটাহাঁটি করে ভোর ছ'টায় ক্যাম্পে ফেরামাত্র খবর পেলাম ফেনীতে ইপি-আর এবং অবাঙ্গালীদের মধ্যে সংঘর্ষের। পুরা কোম্পানী নিয়ে ফেনী যাবার সিদ্ধান্ত নিলে সুবেদার সিরাজ ফেনী যাওয়া থেকে বিরত থাকতে বলেন। কেননা আমাদের হাতে কয়েকটি রাইফেল ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তাঁর কথামত কোম্পানী রেখে আমি নিজে স্বচক্ষে পরিস্থিতি দেখার জন্য ফেনী রওনা হই। ফেনীর পরিস্থিতি দেখে চৌমুহনীতে ফিরে আসি এবং নোয়াখালীর সমস্ত পরিষদ সদস্য এবং আওয়ামী লীগ নেতৃবর্গের সঙ্গে জরুরী পরামর্শে বসি।

 ৮ই এপ্রিল, ১৯৭১: নোয়াখালীর ডেপুটি কমিশনার জনাব মঞ্জুর সাহেব সারা দেশের পরিস্থিতি আলোচনার জন্য আমাকে ডেকে পাঠান। নোয়াখালীর প্রতিরক্ষার জন্য তাগাদা দেন। বিকেলে ক্যাপ্টেন এনামুল হক সাহেব কোম্পানী পরিদর্শন করে আমাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন।

 ৯ই এপ্রিল, ১৯৭১: শত্রুর তুলনায় সামান্য অস্ত্র এবং যোদ্ধা নিয়ে ফরোয়ার্ড লাইনের প্রায় সবটাই কভার করে নিই। এ-দিন নাথের পেটুয়া স্টেশনের কাছে আরও একটি ফরোয়ার্ড ডিফেন্স স্থাপন করি।

 ১০ই এপ্রিল, ১৯৭১- লাকসামে প্রথম সামনাসামনি যুদ্ধঃ ১০ই এপ্রিল বর্বর পশুশক্তির বিরুদ্ধে শুরু হয় মুখোমুখী যুদ্ধ। নোয়াখালীর পরিষদ সদস্যদের দেওয়া চারশত টাকা ফরোয়ার্ড ডিফেন্স বাহিনীতে ভাগ করে দিতে যাই লাকসামে সকাল ১০টায়। বেলা ১২টার সময় খবর পেলাম পাকবাহিনী বাঘমারা থেকে লাকসামের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার সংকল্প নিই। লাকসামের সামান্য উত্তরে পশুশক্তিকে বাধা দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে সেই অনুসারে পজিশন নেওয়া হ'ল। মাত্র ৭০ জন যোদ্ধা নিয়ে এই অভিযান চালাই। সঙ্গে দুটো এল-এম-জি ছাড়া বাকী সবই ৩০৩ রাইফেল ছিল। তাই নিয়ে শত্রুর অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে বসে রইলাম সন্ধ্যে ৬ টা পর্যন্ত। কিছুক্ষণ পর শত্রুপক্ষ যখন আমাদের রেঞ্জের ভিতরে চলে আসে তখনই একসঙ্গে গোলাগুলী শুরু করি। আমার এ অতর্কিত আক্রমণে পাকবাহিনীর দুজন লেফটেন্যাণ্টসহ ২৬ জন সৈন্য নিহত হয় এবং ৬০ জন আহত হয়। পর মুহূর্তে সামলে নিয়ে পাকবাহিনীর সৈন্যরাও মেশিনগান, মর্টার ও আর্টিলারীর গোলাগুলী শুরু করে বৃষ্টির মত গুলীবর্ষণ শুরু হলো। প্রায় ৪ ঘণ্টা গোলাগুলী বিনিময় হয়। শত্রুপক্ষের দুটো ট্রাকে আগুন ধরে যায়। ক্রমেই আমাদের গোলাবারুদ শেষ হতে থাকে। সরবরাহ ও সাহায্যের