পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৪৪

কোন আশা ছিল না। অপর পক্ষে পাকবাহিনী ময়নামতি থেকে সারবরাহ ও সৈন্য পেয়ে দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের উপর। কাজেই অক্ষত সৈন্যদের নিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হই। ফলে পাকবাহিনী লাকসাম দখল করে নেয়।

 রাতে নূরুল হক সাহেব, নাগাবাবুসহ অপর দুজন পরিষদ সদস্য ২টা এল-এম-জি ও ৪টা এস-এল- আর আমার হাতে অর্পণ করেন। কিছু বিস্ফোরক দ্রব্য দিয়ে দৌলতগঞ্জ সেতু উড়িয়ে দিই এবং লাকসাম- নোয়াখালী সড়কের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে সক্ষম হই।

 ২০শে এপ্রিল, ১৯৭১-নাথের পেচুয়ার মুখোমুখি যুদ্ধঃ ১০ই এপ্রিল সারারাত সেতু ধ্বংস করায় ব্যস্ত থাকায় ভোরে বিপুলাশ্বরে পৌঁছামাত্র মাইজদী থেকে টেলিফোনযোগে খবর পেলাম যে, লাকসামে অবস্থানরত পাকসৈন্যরা নোয়াখালীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আমি তৎক্ষণাৎ কোম্পানীকে ফল-ইন করিয়ে সুবেদার সিরাজ সাহেবকে কে প্লাটুনের কমাণ্ডার নিযুক্ত করি এবং সুবেদা রজব্বার সাহেবকে দ্বিতীয় প্লাটুনের কমাণ্ডার নিযুক্ত করে দিই। আমি নিজে তৃতীয় প্লাটুনটি কোম্পানী হেডকোয়ার্টারসহ নিয়ে নাথের পেটুয়া অভিমুখে দ্রুতগতিতে ছুটে গিয়ে স্টেশনের পূর্ব দিকের দায়িত্ব সুবেদার সিরাজ সাহেব ও জব্বার সাহেবের উপর অর্পণ করি এবং আমি পশ্চিম কি রক্ষার দায়িত্ব নিই। তাদেরকে এ কথাও জানাই যে, আমাদের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের যখন কোন ব্যবস্থ নেই, সেহেতু শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যেন কেউই পশ্চাদসরণ না করেন।

 আমি নিজের প্লাটুনকে প্রত্যেক সেকশনের পজিশন স্বহস্তে দেখিয়ে দিই। খনন কার্য শেষ না হতেই হঠাৎ নায়েক সিরাজ সতর্ক সংকেত দ্বারা আমাকে দেখালেন যে শত্রুপক্ষ ক্রলিং করে আমাদের পজিশনের নিকটে এসে গেছে। আমি চেয়ে দেখি সত্য সত্যই শত্রুরা ধানক্ষেতের ভিতর দিয়ে প্রায় এক কোম্পানী ক্রলিং করে এমনভাবে আমাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছে যা ধারণা করা যায় না। আমি তৎক্ষণাৎ এস-এল-আর’এর মাধ্যমে গুলি শুরু করি। নায়েক সিরাজও এল-এম-জি'র মাহায্যে শত্রুর উপর আঘাত করে। বলতে গেলে আমার সমস্ত প্লাটুনের সৈন্যরা একসাথে আগত শত্রুর প্রত্যেককে আহত বা নিহত করতে সক্ষম ছিল। এরপর তাদের ফলো-আপ কোম্পানী দ্বিগুণ বেগে তাদের সাপেটিং বা সাহায্যকারী অস্ত্রের দ্বারা দ্রুতবেগে অগ্রসর হবার চেষ্টা করে বিফল মনোরথ হয়ে আহত ও নিহত সৈন্যদেরকে সরিয়ে নিয়ে পিছনে চলে যায় এবং তারপর আমাদের উপর আর্টিলারী এবং মর্টারের গোলাবর্ষণ করতে থাকে। পূর্ব দিক থেকে যখন আমার দ্বিতীয় প্লাটুনের ল-এম-জি'র ফায়ার শত্রুপক্ষের উপর পড়ছিল তখন শত্রুরা তাদের উপরও (দ্বিতীয় প্লাটুনের উপর) অনবরত শেলিং করতে থাকে। পরিণামে আমার একজন সৈন্য তৎক্ষণাৎ শহীদ হন এবং একজন গুরুতরভাবে আহত হন। আমি বাধ্য হয়ে প্লাটুনকে ২০০ গজ পশ্চাতে একটা ডোবার পাশে দৌড়ে পজিশন নিতে আদেশ দিই। শত্রুর দুই প্লাটুনের মত সৈন্য আমার প্রথম পজিশনটি দখল করে ফেলে। এ সময় আমি আমার প্লাটুনকে আদেশের মাধ্যমে দ্বিতীয় ডিফেনসিভ পজিশনে নিয়ে যাই। এবং পুনরায় শত্রুর গতিবিধি লক্ষ্য করেই গুলি আরম্ভ করি। এমন সময় হঠাৎ তিনখানা যুদ্ধ-বিমান সোজা আমাদের উপর ডাইভ করে পর পর তিনবার আক্রমণ চালায়। তারা প্রচুর পরিমাণ গুলি ছোঁড়ে এবং নাপাম বোমা ফেলতে থাকে। আমাদের সৌভাগ্য যে, সমস্ত গুলি এবং বোমাগুলো লক্ষ্যভ্রষ্ঠ অনবরত যুদ্ধ চলতে থাকে। শত্রুদের আর এক ইঞ্চি অগ্রসর হওয়ার ক্ষমতা ছিল না তখন আমি পূর্বদিকে অবস্থানরত দুই প্লাটুনের কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে আমার একজন জোয়নকে তাদের খবর আনতে পাঠাই। এ সময় পূর্ব দিকের গ্রামগুলি আগুনে শুধু জ্বলতে দেখি। সংবাদদাতা ফিরে এসে জানালো যে, পূর্বদিকের দুই প্লাটুন তাদের স্ব-স্ব অবস্থান থেকে সৈন্য তুলে নিয়ে অন্য কোথাও চলে গেছে। এ কথা শোনার পর আমি বাধ্য হয়ে অলরাউণ্ড ডিফেন্স করি। এভাবে সন্ধ্যে পর্যন্ত গোলাগুলী বিনিময় হয়। সন্ধ্যের পর পাকবাহিনী রেকি পেট্রলিং শুরু করে। তারা আমাদের উপর ফাইটিং পেট্রল পাঠায়। আমার সঙ্গে দু'ঘণ্টা পর্যন্ত যুদ্ধ হয়। তারা যাবতীয় অস্ত্র দ্বারা গুলি করতে থাকে এবং কিছুক্ষণ পর তারা চলে যায়।