পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৪৫

 সারাদিন ধরে যুদ্ধ করার পর অনাহার আর অবিশ্রামে আমরা অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ি। মুখ দিয়ে কথা বের হচিছল না আমাদের। এমতাবস্থায় পুনরায় যুদ্ধ করার মানসিকতা হারিয়ে ফেলি এবং রাত সাড়ে দশটার সময় আমি আমার যোদ্ধাদের নিয়ে সোনাইমুড়ি অভিমুখে রওনা হই। এ সময় রাস্তায় কোন জনগণের সাড়াশব্দ ছিল না। প্রত্যেক বাড়ির লোক ধন-সম্পদের আশা ত্যাগ করে অন্যত্র আশ্রয় নিয়ে চলে গেছে। সোনাইমুড়িতে পৌঁছে ড. মফিজ সাহেবের সাক্ষাৎ পাই। আমাদের বিশেষ করে আমাকে দেখে তিনি জড়িয়ে ধরেন। (ড. মফিজ খবর পেয়েছিলেন যে, আমরা পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে মারা গিয়েছি)। তারপর তিনি আমাকে ও আমার সৈন্যদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করেন।

 ২১শে এপ্রিল ভোরে শত্রুদের পুনরায় অগ্রসর হবার খবর পেলাম। পূর্বদিন যুদ্ধে আমরা অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ি। তাছাড়া এ্যামুনিশনও তেমন ছিল না। তবু শত্রুবাহিনীর অগ্রগতি রোধ করার সিদ্ধান্ত নিই। এবং সে অনুযায়ী সোনাইমুড়ি রেল স্টেশনের আউটার সিগন্যালের কাছাকাছি এ্যামবুশ পার্টি বসাই। কিছুক্ষণ পর শত্রুবাহিনীর জোয়ানরা অগ্রসর হতে থাকে। প্রথমে আমরা গুলী চালাই। শত্রুপক্ষ ৩” মর্টার ও মেশিনগান থেকে গুলী চালায়। বেশ কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলে। বেলুচ রেজিমেণ্টের কয়েকজন সৈন্য হতাহত হয়। ইতিমধ্যে আমাদের এ্যামুনিশন শেষ হয়ে গেলে আমি আমার বাহিনীকে উইথড্র করে চলে আসি। পাকবাহিনী সোনাইমুড়ি দখল করে চৌমুহনীর দিকে অগ্রসর হয়।

 আমি আবিরপাড়ায় একটি গোপন বৈঠক দিই। এখানে কর্মীদের বিপুল উৎসাহ দেখা যায়। নায়েক সুবেদার ওয়ালীউল্লাহ ও ইসহাক মাতৃভূমি রক্ষার্থে আমার সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন।

 ২৪শে এপ্রিলং আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট কর্মী জনাব আমীন উল্লা মিয়ার সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়। তিনি বর্বর পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য আমাকে সাহস দেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা ও খাওয়ার নিশ্চয়তা দেন। তিনি প্রথমবারের মত ভারত থেকে অস্ত্রশস্ত্র আনার জন্য এবং রাস্তা ঠিক করার জন্যে ভারতে চলে যান। এইদিনে সুবেদার ওয়ালীউল্লাহ চট্টগ্রাম ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে এসে আমার কোম্পানীতে যোগদান করেন।

 ২৬শে এপ্রিলঃ হাবিলদার নূর মোহাম্মদকে সঙ্গে নিয়ে বিপুলাশ্বর স্টেশনের দক্ষিণে এক আড়ালে এ্যামবুশ করি। সকালে পাকবাহিনরি ৬জন সিগনালম্যানসহ দু'খানা গাড়ী যাবার সময় এম-এমজি দ্বারা ব্রাশ করলে তাদের একখানা গাড়ী নষ্ট হয়ে যায় এবং দু'জন আহত হয়। পাকবাহিনী আহত ব্যক্তিদ্বয়কে নিযে অন্য গাড়ীসহ পালিয়ে যায়। এখানে হাবিলদার নূর মোহাম্মদ অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দেন। এখানে দুটো রাইফেল উদ্ধার করি।

 ২৮শে এপ্রিলঃ সিপাই শাহজাহানকে সঙ্গে নিয়ে সোনাইমুড়িতে রেকী করি। ২৯শে এপ্রিল নায়েক সফি তার সেকশন নিয়ে সোনাইমুড়ি আউটার সিগন্যাল পুনরায় অ্যামবুশ করে। কিছুক্ষণ পর পাকবাহিনীর তিনখানা গাড়ী অগ্রসর হতে থাকলে সফি ফায়ার শুরু করে। ফায়ারে সম্মুখের গাড়ীখানা অকেজো হয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে শত্রুপক্ষ পজিশন নিয়ে পাল্টা ফায়ার শুরু করে। দু'তিন ঘণ্টা যাবৎ গোলাগুলী বিনিময় হয়। কিন্তু এ্যামুনিশন শেষ হয়ে গেলে আমাদের জোয়ানরা গা-ঢাকা দেয়। শত্রুপক্ষের একজন গুরুতরভাবে আহত হয়। এখানে পাকবাহিনীর গুলীতে একটি ছেলে ও এক বৃদ্ধ মারা যায়।

 ১লা মে-বগদীয়ার যুদ্ধঃ নায়েক সিরাজ এক প্লাটুন যোদ্ধা নিয়ে বগাদীয়া সেতুর কাছে এ্যামবুশ করে। এ জায়গা দিয়ে একখানা জীপসহ তিনখানা ৩-টনী লরী কিছু দূরত্ব বজায় রেখে অগ্রসর হবার সময় নায়েক সিরাজ পাকবাহিনীর উপর চরম আক্রমণ চালায় এবং প্রথম ও শেষ গাড়ীখানার উপর অনবরত গুলী চালালে ৩-টনী একখানা গাড়ী সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। এখানে ১৫/২০ জন খানসেনা সঙ্গে সঙ্গে নিহত হয়, কয়েকজন আহত হয়। পরক্ষণে পাকসেনারা ৩” মর্টার ও মেশিনগান হতে অবিরাম গোলাগুলী বর্ষণ করতে থাকে। দীর্ঘ সময় যুদ্ধের পর