পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১৭৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৫০

মত লোকদের পক্ষে এত তাড়াতাড়ি তাদের সন্ধান পাওয়া সহজ নয়। অতিরিক্ত আগ্রহ দেখালে হয়তোবা সন্দেহভাজন হয়ে পড়ব! শুনলাম শহর থেকে মাইল পাচেক দূরে প,বি, হাসপাতালে মুক্তিবাহিনীর দশ-বারো জন আহত যোদ্ধা রয়েছে। সেখানে গিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করলে আমাদের মনের আশা মিটতে পারে।

 কিন্তু কাজটা কি এতই সহজ! আমরা যে পাকিস্তানের গোয়েন্দা বিভাগের লোক নই তারই বা প্রমাণ কি? এখনকার অবস্থায় এই সন্দেহ তো জাগতেই পারে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে নেমে দেখলাম, আমাদের খুব বেশী বেগ পেতে হোল না। আমরা যে পরিচয়সূত্রটুকু নিয়ে গিয়েছিলাম, তাতেই কাজটা সহজ হয়ে গেল। বেলা এগারোটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা তাদের মুখে তাদের নানা কাহিনী শুনলাম। আমার মনে হোল তারা যেন প্রথমত কিছুটা আড়ষ্ট বোধ করছিল, পরে কথা বলাবলির মধ্যে দিয়ে আমাদের সম্পর্কটা সহজ হয়ে গেল।

 সবসুদ্ধ চার জায়গার চারজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে আমরা আলাপ করেছি। তিনজের সাথে কথা শেষ করে চতুর্থ জনের সঙ্গে কথা শুরু করতেই চমকে উঠলাম। আমি প্রশ্ন করেছিলাম, আপনি কোন জায়গায় লড়াই করে জখম হয়েছেন। তিনি উত্তর দিলেন-সে জায়গার নাম বড়কামতা এই কথা শোনার পর আমার চমকে ওঠার কথাই তো। এই তো মাত্র ক'দিন আগে কড়কামতায় এক রাত্রি যাপন করে এসেছি। সে কথা কি এখনই ভুলে যেতে পারি!

 বড়কামতা?

 হ্যাঁ, বড়কামতা। আমার মানসচক্ষে সেই স্বল্পভাষী যুবকটির মুখ ভেসে উঠছিল। আর স্মৃতিপটে ভেসে আসছিল স্খলিত কণ্ঠে বৃদ্ধের সেই ব্যাকুল প্রার্থনা, দুর্গা, দুর্গা। তাহলে আমার সেই এক রাত্রির স্নেহঘন আশ্রয় বড়কামতা গ্রামটিও যুদ্ধের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে?

 ওরা কোন তারিখে হামলা করেছিল আর সেই সময় আপনারাইবা সেখান থেকে কতদূরে ছিলেন?

 ওরা হামলা করেছিল ৩০-এ, অর্থাৎ ৩০-এ এপ্রিল তারিখে।

 আমরা ২৫-এ তারিখে প্রথম সেখানে যাই। তার পর থেকে সেখানেই ছিলাম। কি আশ্চর্য কাণ্ড, আর কি অদ্ভুত যোগাযোগ!

 আমি খুব তাড়াতাড়ি মনে মনে হিসেব করে দেখলাম আমরা চার বন্ধু সেই ২৫-এ এপ্রিল তারিখেই বড়কামতায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। এঁরাও আমাদের কাছাকাছি ছিলেন। কিন্তু আমরা বাইরের লোক, এঁদের কেমন করে জানব।

 আপনার ক'জন ছিলেন?

 আমরা মুক্তিবাহিনীর দশজন লোক সেখানে গিয়েছিলাম। কিন্তু ঐ ক'টি দিনের মধ্যে ঐ অঞ্চলে আরও পাঁচজন লোককে ট্রেনিং দিয়ে আমাদের দলের সঙ্গে যুক্ত করে নিয়েছিলাম বলে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা দাঁড়াল পনের।

 এই ক'দিনে বড়কামতার লোকেরা আমাদের, নিজেদের আপন জনের মত গ্রহণ করে নিয়েছিল। আমরা সবাই মিলেমিলে সংসার করছিলাম। আমরা এখান থেকে ওখান থেকে বড় বড় মাছ ধরে আনতাম। কখনো তাঁরা রান্না করতেন, কখনো বা আমরা। কিন্তু খাবার বেলায় সবাই ভাগাভাগি করে খেতাম। কিসের হিন্দু আর কিসের মুসলমান, আমাদের জাত-পাতের বালাই ছিল না।

 উপর থেকে নির্দেশ পেয়ে আমরা ২৯শে এপ্রিল তারিখে চান্দিনার পূর্বদিকে ঢাকা-কুমিল্লা সড়কের একটা পুল উড়িয়ে দিলাম। ক'দিন থেকেই চান্দিনা অঞ্চলে মিলিটারিরা বেশ তোড়জোর চালাচ্ছে দেখতে পাচ্ছিলাম।