পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।



১৫১

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড

 কয়েকদিনের মধ্যে এরা একটা কিছু ঘটাবে সেটা মনে মনে অনুমান করেছিলাম। আমাদের এই ছোট দলটিও সেজন্য তৈরী ছিল। ওরা একটা কিছু অঘটন ঘটালে আমরাও একেবারে চুপ করে থাকব না। ওরা যাই মনে করে থাকুক না কেন, ব্যাপারটা একদম একতরফা হবে না।

 ২৯ তারিখে পুল উড়িয়ে দেবার পর ওরা কোথাও না কোথাও হামলা করবেই। কিন্তু ওদের সেই হামলাটা কোথায় হবে সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন।

 কিন্তু এ নিয়ে বেশী মাথা ঘামাতে হোল না। ওরা পরদিন সকালবেলা চারখানা সৈন্য বোঝাই গাড়ি সাজিয়ে এই বড়কামতায় এসে হানা দিল। ওরা কি তবে সন্দেহ করতে পেরেছে যে, আমরা এখানে এসে আশ্রয় নিয়ে আছি? কিন্তু তখন বেশী ভাববার সময় ছিল না। ওরা প্রথমেই কতকগুলি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিল। ওদের সংখ্যা পঞ্চাশ থেকে ষাট। ইতিমধ্যে আমরা মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা ওদের দৃষ্টির আড়ালে দাঁড়িয়ে নিজ নিজ পজিশন নিয়ে নিয়েছি। ওরা প্রথমেই কোন বাধা না পেয়ে নিশ্চিন্ত মনে তাদের ধ্বংসের কাজে এগিয়ে চলেছিল।

 আমরা প্রথম সুযোগ পাওয়া মাত্র একই সঙ্গে চারটা গাড়ির উপর ‘ব্রাশ করে চললাম। আমাদের মিলিটারি ভাষায় ‘ব্রাশ” কথার মানে একই সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গুলির পর গুলি চালিয়ে যাওয়া। থামিয়ে না দিলে এইভাবে ক্রমান্বয়ে গুলির পর গুলি চলতে থাকে। এই একটানা গুলিবর্ষণের ফলে সৈন্য-বোঝাই চারটা গাড়িই লণ্ডভণ্ড হোতে চলল। আমাদের এই প্রচণ্ড আক্রমণ শেষ পর্যন্ত ওরা সহ্য করতে না পেরে প্রাণ নিয়ে পালাল।

 ৩০শে এপ্রিলের যুদ্ধের এটা প্রথম পর্ব। এরপরই যে দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়ে যাবে সেটা বুঝতে বেশী বুদ্ধির দরকার করে না। এখানে ক্যাণ্টনমেণ্ট কতই বা দূর। কিন্তু দ্বিতীয় পর্বটা যে এত তাড়াতাড়ি শুরু হয়ে যাবে তা আমরা ভাবতে পারিনি। এর এক ঘণ্টা কি দেঢ় ঘণ্টা বাদেই ওরা সৈন্য বোঝাই গাড়ির মিছিল সাজিয়ে চলে এল। ওদের আঠারটা ট্রাক বিকট আওয়াজে পথঘাট কাঁপিয়ে এই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে দ্রুতবেগে ছুটে আসছিল। অনুমানে বুঝলাম প্রতিপক্ষ দুশ জনের কম হবে না। ওদের সঙ্গে মর্টার, মেশিনগান, রাইফেল কোন কিছুর অভাব ছিল না। ওরা এবার রীতিমত শিক্ষা দিয়ে যাবে। ওরা এসেই বেশ বড় একটা এলাকাকে ঘেরাও করে ফেলল।

 আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে চারজন সেই ঘেরাও-এর মধ্যে আটকা পড়ে গেছে। আমাদের ঘেরাও-এর সুবিধা হচ্ছে এই যে, ওদের আমরা ভালভাবেই দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এত সমস্ত লোকের ভিড়ে মুক্তিযোদ্ধারা কোথা মিশে আছে এবং তারা কোথায় কোথায় পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে সম্পর্কে ওদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।

 বড়কামতা গ্রামের অধিবাসীদের মধ্যে বেশ বড় একটা অংশ বারুই বা বারুইজীবী শ্রেণীর লোক। সেজন্য গ্রামের এখানে ওখানে বহু পানের বরোজ আছে। এই বরোজগুলো সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল এগুলির মধ্যে আশ্রয় নিয়ে তারা শত্রদের বেছে বেছে তাক করে মারছিল।

 একটা কথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার পাকসৈন্যদের বিরুদ্ধে শুধু যে আমরাই লড়াই করছিলাম তা নয়, গ্রাম থেকে দলে দলে লোক এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। দুএকশ লোক নয়, আমার মনে হয় তাদের সংখ্যা দু-তিন হাজারের কম হবে না। লোকগুলি ক্ষিপ্তের মত ছুটে আসছিল। তাদের হাতে লাঠিসোটা, বর্শা-বল্লম থেকে শুরু করে বন্দুক পর্যন্ত। এই দুঃসাহসী লোকগুলি এই হাতিয়ার নিয়ে মর্টার আর মেশিনগানের বিরুদ্ধে লড়াই করতে ছুটে আসছে। এদের উন্মাদ ছাড়া র কি বলা চলে! কিন্তু একটা কথা স্বীকার করতেই হবে যে, তাদের এই উন্মাদনা আমাদের মধ্যে নতুন শক্তি ও অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করে তুলেছিল। ওরা নানারকম জয়ধ্বনি আর বিকট গর্জন করতে করতে ছুটে আসছিল। সেই গর্জন শত্রদের মনেও ভয়ের কপিন জাগিয়ে তুলেছিল। ওরা কেমন যেন দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। এ ধরনের ঘটনা যে ঘটতে পারে এটা