পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৫৭

পাঁজার পেছনে একটি জনপ্রাণী নেই। শুধু মাটর উপরে অনেকগুলি কার্তুজের খোল ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়ে আছে।

 সেদিনকার যুদ্ধে সবসুদ্ধ ২৩ জন সৈন্য হতাহত হয়েছিল। আর মুক্তিবাহিনীর জওয়ান সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে আসতে পেরেছিল। যে দেশদ্রোহী দালালটি শত্রুদের সাহায্যে করবার জন্য এগিয়ে এসেছিল, এর কয়েকদিন বাদেই মুক্তিযোদ্ধারা তাকেও খতম করল।

 সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ঘা খেয়ে পাকসৈন্যদের চূড়ান্তভাবে নাকাল হতে হয়েছিল। চন্দ্রগঞ্জে লুটপাট করা দূরে থাক, হতাহত বন্ধুদের নিয়ে গাড়ি বোঝাই করে ওরা মাথা হেট করে ফিরে এসেছিল কিন্তু এই অপমান আর লাঞ্ছনা ওরা ভুলে যেতে পারেনি। দিন কয়েক বাদে ওরা আবার নতুনভাবে তৈরী হয়ে চলল চন্দ্রগঞ্জের দিকে। তাদের মনের জ্বালাটা এবার ভাল করেই মিটিয়ে নেবে।

 পাকসৈন্যরা আবার হামলা করতে আসছে, এই খবরটা পৌঁছে গিয়েছিল চন্দ্রগঞ্জে। সুবেদার লুৎফর রহমান এখন সেখানে নেই, অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও কেউ নেই। এবার কে তাদের প্রতিরোধ করবে? ওরা সেদিন আচ্ছামত ঘা খেয়ে ঘরে ফিরে গেছে, এবার ভাল করেই তার প্রতিশোধ তুলবে। চন্দ্রগঞ্জকে এবার ওরা ধ্বংশস্তুপে পরিণত না করে ছাড়বে না। যাকে পাবে তাকেই মারবে। ওদের হাতে কেউ কি রেহাই পাবে? সারা অঞ্চলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। চন্দ্রগঞ্জের মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে লাগল। ওরা ওদের যা করবার বিনা বাধায় করা যাবে।

 কিন্তু চন্দ্রগঞ্জের একটি মানুষ এই কথাটাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না। না, কিছুতেই না, গর্জে উঠলেন তিনি, এ আমি কিছুতেই হতে দেব না। আর যদি কেউ না যায়, আমি একাই যাব, একাই গিয়ে ওদের সঙ্গে লড়াই করব।

 কে এই লোকটি? কি তাঁর নাম? না, তাঁর নাম আমার জানা নেই। কোন খ্যাতনামা লোক নন তিনি। একজন বৃদ্ধ প্রাক্তন সৈনিক। আর দশজন বৃদ্ধের মত তিনিও তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলি ‘আল্লাহ আল্লাহ’ করে কাটিয়ে যাচ্ছিলেন। একজন সাধারণ মানুষ। কেউ কোনদিন তাঁর কোন অসাধারণত্বের পরিচয় পায়নি। কিন্তু আজ দেশের এক বিশেষ অবস্থায় একটি বিশেষ অনুকূল মুহুর্তে তাঁর ভেতরকার সুপ্ত আগুনকে জাগিয়ে তুলিছে। যেখানে হাজার হাজার মানুষ ভয়ে অস্থির সেখানে এই একটি মানুষ দৃঢ় নিষ্কম্প কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, যদি একা যেতে হয়, আমি একাই যাব, আমি একাই ওদের সঙ্গে লড়াই করব। মরবার আগে এই হিংস্র পশুগুলির মধ্যে একটাকেও যদি মেরে যেতে পারি, তবে আমার জীবন সার্থক হবে।

 যারা তাঁর হিতৈষী, তারা তাঁকে নিবৃত্ত করবার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করেছিল। বলেছিল, তুমি একা মানুষ, তার উপরে বুড়ো হয়েছ, তুমি কি করে ওদের সঙ্গে লড়াই করবে? কিন্তু কারও কোন বাধা তিনি মানলেন না, দৃঢ় মুষ্টিতে রাইফলটা আঁকড়ে ধরে বেরিয়ে পড়লেন ঘর থেকে। তাঁর এই দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর তরুণ ছেলে তাঁকে ডেকে বলল, দাঁড়াও আব্বা, আমিও তোমার সঙ্গে যাব। তোমার মত আমিও ওদের সঙ্গে লড়াই করব। ছেলের কথা শুনে বাপের মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। দুজনের হাতে দুটি রাইফেল পিতাপুত্র পাশাপাশি প্রতিরোধ সংগ্রামে যাত্রা করল।

 আজও ওরা সেই ইটের পাঁজার পেছনে আশ্রয় নিল। ওরা পিতা-পুত্র পাশাপাশি বসে শত্রুদের আগমনের জন্য অধীর চিত্তে প্রতিক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণ বাদে দূর থেকে মোটর ভ্যানের গর্জন শোনা গেল। হ্যাঁ, এইবার ওরা আসছে। দেখতে দেখতে সৈন্যবাহী গাড়ি একেবারে কাছে এসে পড়ল। সৈন্যদের মধ্যে অনেকের কাছেই এই ইটের পাঁজাটি সুপরিচিত। ঐটিকে ভুলে যাওয়া তাদের পক্ষে কোন মতেই সম্ভব নয়, কিন্তু আজও যে