পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১৮৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৫৮

কেউ তাদের আক্রমণ করবার জন্য এর আড়ালে ওঁৎ পেতে বসে থাকতে পারে, এটা তারা ভাবতে পারেনি। ভাবেত না পারা স্বাভাবিকও নয়। কিন্তু ওরা এই স্তুপটার বরাবর আসতেই পর পর তিনজন সৈন্য গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে গেল। সবাই দেখতে পেল, কে বা কারা তাদের লক্ষ্য করে স্তপটার আড়াল থেকে গুলিবর্ষণ করে চলেছে। সঙ্গে সঙ্গেই সৈন্যরা এর পাল্টা জবাব দিল। ইটের পাঁজাটাকে লক্ষ করে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলিবর্ষণ চলল। এরপর সেই স্তপের পেছন থেকে আর কোন গুলির শব্দ শোনা গেল না। সৈন্যরা একটু সময় অপেক্ষা করল, তারপর ছুটে গেল স্তূপটার সামনে। উদ্যত রাইফেল বাগিয়ে ধরে যখন তারা পায়ে পায়ে সেই স্তূপটার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল, তখন দেখতে পেল, সেখানে এক বৃদ্ধের রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়ে আছে। কিন্তু অস্ত্র বলতে কোন কিছু সেখানে নেই, শুধু কয়েকটা কার্তুজের খোল পড়ে আছে। ওরা বুঝল, এই বৃদ্ধের সঙ্গে আরও যারা ছিল তারা অস্ত্রসহ পালিয়ে গিয়েছে।

॥ সোনাইমুড়ি রেলস্টেশন ॥

 চন্দ্রগঞ্জের যুদ্ধের পর সুবেদার লুৎফর রহমান নোয়াখালীর বিভিন্ন অঞ্চলে শিকারের সন্ধানে ছুটে চলেছিলেন। তাঁর এক মুহূর্তেও বিশ্রামের অবকাশ নেই। তিনি পাকসৈন্যদের গতিবিধি সম্পর্কে দক্ষ শিকারীর মত তীক্ষ্ণ সন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে ফিরছিলেন। মুক্তিবাহিনীর গুপ্তচরেরা নিত্য নতুন সংবাদ নিয়ে আসছে। আর সেই সূত্র অনুসরণ করে তাদের মুক্তিবাহিনী যেখানেই সুযোগ পাচ্ছে, সেখানেই শত্রুদের উপর ঘা দিয়ে চলেছে।

 এপ্রিলের শেষ ভাগ। খবর এল একদল সৈন্য কুমিল্লার লাকসাম থেকে ট্রেনে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি স্টেশনে এসে পৌঁছবে। লুৎফর রহমান এই খবর পাওয়ার সাথে সাথেই তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে পরামর্শ করতে বসলেন। স্থির হোল, ওদের বিনা বাধায় এগুতে দেওয়া হবে না, সোনাইমুড়ি স্টেশনেই এই হামলাকারীদের উপর হামলা করতে হবে। রেলস্টেশনে চড়াও হয়ে আক্রমণ। হয়তো সেজন্য মুক্তিবাহিনীকে বেশ কিছুটা মূল্য দিতে হবে, অনেক ক্ষয়ক্ষতি বরণ করে নিতে হবে। তা হোক, এই শিকারকে কিছুতেই ফস্কে যতে দেওয়া চলবে না।

 কিন্তু এবার আর চন্দ্রগঞ্জের যুদ্ধের মত সাতজন মুক্তিযোদ্ধা দিয়ে চলবে না। এবার আর আগেকার মত আড়াল থেকে যুদ্ধ নয়, যুদ্ধ বলবে দিবালোকে প্রকাশ্যে, মুখোমুখি। ওদের সৈন্যসংখ্যা বড় কম নয়, আক্রমণ করতে হলে বেশ কিছুটা শক্তি সংগ্রহ করে নিতে হবে সেই অল্প সময়ের মধ্যেই পঞ্চাশজন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাকে সোনাইমুড়িতে এনে জড় করা গেল। অবশ্য যতদূর জানা গিয়েছে, সৈন্যদের সংখ্যা এর চেয়েও অনেকটা বেশী। তাহোক, এই শক্তি নিয়েই ওদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে।

 নির্দিষ্ট সময়ে সৈন্যবাহী ট্রেনটা সোনাইমুড়ি স্টেশনে এসে পৌঁছল। মুক্তিবাহিনী কাছেই কোন একটা জায়গায় লুকিয়ে ছিল। ট্রেনটা এসে পৌঁছবার সাথে সাথেই রাইফেলধারী মুক্তিযোদ্ধারা বিদ্যুৎগতিতে ছুটে এসে ট্রেনটাকে ঘেরাও করে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে তারা ট্রেনের আরোহীদের লক্ষ্য করে গুলি চালাতে লাগল। ওরা গাড়ির ইঞ্জিনটাকেও লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছিল। ড্রাইভার ইঞ্জিন থেকে লাফিয়ে পড়ে প্রাণ নিয়ে পালাল। ফলে ড্রাইভারহীন ট্রেনটা অচল হয়ে গেল।

 প্রকাশ্য দিবালোকে এইভাবে আক্রান্ত হতে হবে, পাকসৈন্যরা তা কল্পনাও করতে পারেনি। তারপর ঘটনাটা এমন দ্রুত ঘটে গেল যে একটু সময় ওরা হতভম্ব আর স্তব্ধ হয়ে রইল। প্ল্যাটফর্মের উপর নেমে পড়তে লাগল। ওদের মধ্যে কয়েকজনকে কামরা থেকে নামবার আগেই মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে প্রাণ দিতে হল।

 এবার দু'পক্ষ শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। এবারকার বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে রেলস্টেশনের উপরে এ ধরনের লড়াই আর কোথাও ঘটেছে বলে শোনা যায়নি। নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি রেলস্টেশন এজন্য স্মরণীয় হয়ে