পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৭৫

৩রা এপ্রিল এই পরিকল্পনা নিই যে, যেহেতু আমাদের সৈন্যদের কম সেহেতু পাকিস্তানী সেনাদের প্রতিরোধ করার জন্য ডিনায়াল প্লান গ্রহণ করি। এর উদ্দেশ্য, রাস্তাঘাট, রেলওয়ে ব্রীজ, রোড ব্রীজ ভেঙ্গে দেয়া যাতে শত্রুরা অতি সহজে সম্মুখে আসতে না পারে। ডিনায়াল প্লান-এর প্রথম আমরা ভৈরবের কাছে রামপুরের ব্রীজ ভেঙ্গে ফেলি। আর কিশোরগঞ্জের কাছে রোড এবং রেলব্রীজ দুটোই ভেঙ্গে দিই। ভৈরবের ব্রীজ ভাঙ্গারও পরিকল্পনা নিই।

 ৪ঠা এপ্রিল দেখা হয়ে গেল কর্নেল ওসমানী (বর্তমানে জেনারেল)-এর সাথে আমারই হেডকোয়ার্টারে তেলিয়াপাড়াতে। তিনি আগরতলা থেকে তেলিয়াপাড়াতে আসেন। আমি প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি যে তিনিই সেই ওসমানী যাকে আমি ভালোভাবে চিনতাম। আমি তাকে চিনতে পারিনি এই জন্যে যে আত্মগোপন করার জন্য গোঁফ কেটে রেখেছিলেন। ঐ দিনই আমি খবর পেলাম যে জিয়াউর রহমান (বর্তমানে বিগ্রেডিয়ার) চট্টগ্রাম থেকে আমার সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য আমার কাছে আসছেন।

 একটা কথা বলা দরকার, ৪ঠা এপ্রিল স্বাধীনতা সংগ্রামের এক মস্ত বড় দিন। সেদিন আমার হেডকোয়ার্টারে অনেক সিনিয়র অফিসার একত্রিত হয়েছিলেন। যাঁরা ছিলেন তাঁরা হলেনঃ ১। কর্নেল ওসমানী (বর্তমানে জেনারেল, বিমান ও নৌযান মন্ত্রী), ২। মেজর জিয়াউর রহমান (বিগ্রেডিয়ার), ৩। মেজর খালেদ মোশাররফ (কর্নেল), ৪। লেঃ কর্নেল সালাউদ্দিন মোঃ রাজা (রিটায়ার্ড কর্নেল), ৫। মেজর কাজী নুরুজ্জমান (রিটায়ার্ড লেঃ কর্নেল), ৬। মেজর নুরুল ইসলাম (লেঃ কর্নেল), ৭। মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী (লেও কর্নেল), ৮। লেঃ কর্নেল আবদুর রব (রিটায়ার্ড মেজর জেনারেল, বর্তমানে এম-পি) এবং অনেকে উপস্থিত ছিলেন। ঐ দিন আমরা কর্নেল ওসমানীকে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে অনুরোধ করি। তিনি সে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। It was decided that day, that the operation for liberation war to be conducted under one command and the commander being colonel M.A.G. Osmany (now rtd. General osmany).

 ঐ দিন আমরা কর্নেল ওসমানীকে এই অনুরোধ করি যে যত শীঘ্র হোক রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা যেন সরকার গঠন করা হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত সরকার গঠিত না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা কোন বৈদেশিক সাহায্য পাব না। ঐ দিন অন্যান্য সিদ্ধান্তের মধ্যে এটাও সাব্যস্ত হল যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সিলেট এলাকার যুদ্ধ পরিচালনার ভার আমার উপর ন্যস্ত থাকবে। কুমিল্লা-নোয়াখালী এলাকার যুদ্ধ পরিচালনার যুদ্ধ পরিচালনার ভার মেজর (বর্তমানে কর্নেল) খালেদ মোশাররফের উপর ন্যস্ত করা হয়। চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের যুদ্ধ পরিচালনার ভার ছিল মেজর (বর্তমানে বিগ্রেডিয়ার) জিয়াউর রহমানের উপর। এই সিদ্ধান্তের পর আমরা যার যার এলাকার সৈন্য মোতায়েন করি।

 ৪ঠা এপ্রিল আমার বাহিনী নিন্মলিখিত এলাকায় নিযুক্ত থাকেঃ প্রায় দুই কোম্পানী সৈন্য নরসিংদীতে, এক কোম্পানী আজবপুরে, এক কোম্পানী আশুগঞ্জে, এক কোম্পানী লালপুরে, এক কোম্পানী সিলেটের শেরপুরে ও শাদিপুরে, এক কোম্পানী সরাইলে (এই কোম্পানী আমার রিজার্ভ কোম্পানী ছিল)। তাদের উপর দুটো টাস্ক দেয়া হয়েছিল। প্রথম টাস্ক হল, যদি দরকার হয় ঢাকার দিক থেকে পাকসৈন্যরা আক্রমণ বৃদ্ধি পেলে লালপুর এবং আশুগঞ্জে যেসব সৈনিক আছে তাদের সাহায্যার্থে তালশহর এবং গোকনঘাট এলাকায় সৈন্য মোতায়েন করবে। দ্বিতীয় টাস্ক হল, যদি সিলেটের দিকে পাক সেনাবাহিনীর আক্রমণ বৃদ্ধি পায় তাহলে শেরপুরে সৈন্যদের সাহায্যার্থে যেন মৌলভীবাজারে সৈন্য মোতায়েন রাখা হয়। এসব কোম্পানী ছাড়াও মেজর (বর্তমানে বিগ্রেডিয়ার) জিয়াউর রহমানের অনুরোধে চট্টগ্রামের সৈনিকদের রি- ইনফোর্সমেণ্ট-এর জন্য আমাকে এক কোম্পানী সৈন্য তাকে দিতে হয়। ৫ই এপ্রিল তারা আমার কাছ থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখে রওয়ানা হয়ে যায়। এবং সে কোম্পানীর অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন এজাজ চৌধুরী।