পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২০৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৮১

তেলিয়াপাড়া তখনও আমাদের অধীন ছিল। পাকবাহিনী তেলিয়াপাড়াকে বাইপাস করে শাহজিবাজারের শায়েস্তাগঞ্জের দিকে চলে যায় এবং সিলেট থেকে আরো অগ্রসরমান পাকসেনাদের শ্রীমংগলে এসে যোগাযোগ করে। তখন থেকে ঢাকা-সিলেট থেকে আরো অগ্রসরমান পাকসেনাদের শ্রীমংগলে এসে যোগাযোগ হয়। তখন থেকে ঢাকা-সিলেট রাস্তা তাদের নিয়ন্ত্রণধীনে চলে যায়। কিন্তু তেলিয়াপাড়া আমাদের নিয়ন্ত্রণধীনে থাকায় পাকবাহিনী সহজে চলাফেরা করতে পারত না। কেননা তেলিয়াপাড়া থেকে চুনারুঘাট পর্যন্ত চা বাগানের ভিতর দিয়ে যে হাইওয়েটা চলে গিয়েছিল সেটা তাদের মরণ ফাঁদ ছিল। প্রায় প্রত্যেক দিনই পাকিস্তানী সেনারা এ্যামবুশের সম্মুখীন হতো এবং তারা বেশ হতাহত হতো।

 সিলেট হাইওয়ে আমাদের নিয়ন্ত্রণধীনে থাকা পর্যন্ত আমরা যেভাবে যুদ্ধ করেছিলাম সেটা ছিল প্রথাগত যুদ্ধ। কিন্তু সিলেট হাইওয়ে পতনের পর আমাদের যুদ্ধের পদ্ধতি বদলিয়ে ফেলে গেরিলা ওয়ারফেয়ার শুরু করি। কিন্তু কনভেনশনাল ওয়ারফেয়ার একবারে বাদ দিয়ে দিইনি। তবে এখন থেকে আমাদের যুদ্ধের প্রধান পদ্ধতি ছিল গেরিলা ওয়ারফেয়ার। আমরা যে সমস্ত ক্যাম্প খুলেছিলাম তা ছিল প্রধানত গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করার জন্য। তাছাড়া কিছুসংখ্যক ট্রেনিং ক্যাম্প কনভেনশনাল পদ্ধতিতে যুদ্ধ করার প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য যে সমস্ত ক্যাম্প খোলা হয়েছিল সেগুলোতে আমাদের ইন্সট্রাক্টর ছাড়াও বন্ধুরাষ্ট্র ভারত থেকে আমরা বেশকিছুসংখ্যক ইন্সট্রাক্টর পেয়েছিলাম। কিন্তু যে সমস্ত ট্রেনিং ক্যাম্পে কনভেনশনাল যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো সে ক্যাম্পগুলোর ইন্সট্রাক্টর সমস্ত আমাদেরই ছিল।

 গেরিলা বাহিনী সমন্ধে এখানে দু-চারটা কথা বলা দরকার। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বা মুক্তির জন্য সমস্ত জনগণ (নিয়মিত ও গেরিলা বাহিনী) মুক্তিবাহিনী হিসেবে পরিচিত ছিল। এই মুক্তি বাহিনীর দুটি অংশ ছিল। একটিকে নিয়মিত বাহিনী বলা হত। অপরটি গেরিলা-তাকে গণবাহিনী বলা হত। এ নামগুলো বাংলাদেশ সরকার দিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের কাছে আমাদের নিয়মিত বাহিনী” “মুক্তি ফৌজ” নামে পরিচিত ছিল। এবং গণবাহিনী ফ্রিডম ফাইটার (এফ, এফ) হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

 এটা আমাদের জানা ছিল যে, গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ জয় করা সম্ভব নয়। দেশ জয় করতে হলে আমাদোর নিয়মিত বাহিনীর দরকার। আমদের বন্ধুরাষ্ট্র কিন্তু এ ব্যাপারে একমত ছিল না। যদিও এটা তাদের অজানা নয় যে দেশ জয় করতে হলে রেগুলার ফোর্স-এর দরকার, শুধু গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ জয় করা যায় না। আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র ভারত রেগুলার ফোর্স বা নিয়মিত বাহিনী গঠন করার বিরুদ্ধে এই জন্য ছিল যে তারা হয়ত মনে করত যদি পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ বেধে যায় তাহলে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান দখল করার সম্পূর্ণ সুনাম যেন তারা নিতে পারে। কিন্তু আমরাও পেশাদার সৈনিক ছিলাম। তাই তাদের এসব পরামর্শে আমরা কখনও কর্ণপাত করিনি এবং আমরা গেরিলা বাহিনীর সাথে সাথে নিয়মিত বাহিনীও গড়ে তুলি।

 তেলিয়াপাড়া-চুনারুঘাটের মরণফাঁদ থেকে বাঁচার জন্য পাকবাহিনী মরিয়া হয়ে ওঠে। আমি তখন তেলিয়াপাড়ার ব্যূহকে আরও সুদৃঢ় করার জন্য বিশেষ পরিকল্পনার ব্যস্ত থাকি। কারণ এটা শুধু আমার ডিফেন্সই ছিল না এটা ছিল আমার হেডকোয়ার্টার।

 পাকবাহিনী তেলিয়াপাড়া তাদের আয়ত্তে আনার জন্য ক্রমাগত ২১ দিন পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যায়। এই যুদ্ধ যখন চলছিল তখন আর একজন অফিসার আমার সাথে যোগ দেয়। তার নাম ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভুঁইয়া (বর্তমানে মেজর)। যেসব অফিসারের উপর তেলিয়াপাড়া রক্ষা করার ভার দিই তারা ছিলঃ ক্যাপ্টেন মতিন (বর্তমানে মেজর), ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভূঁইয়া, (বর্তমানে মেজর), লেঃ মোরশেদ (বর্তমানে ক্যাপ্টেন)। এ ছাড়াও আরো কিছুসংখ্যক কলেজের ছাত্রও ছিলেন। তাঁরা হলেন শহীদ সেলিম আহসান, আনিসুল হাসান, ফজল হোসেন, আনিসুর রহমান (পরবর্তীকালে এঁরা সবাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমিশন পান এবং অফিসার হন)। এদের মধ্যে সেলিম মিরপুর অপারেশনে শহীদ হন এবং আনিস তাঁর কলেজ জীবনে ফিরে যান।