পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৮৬

আন্দাজ করতে পারলাম। প্লাটুন কমাণ্ডার আমাকে জানালেন, গত দুই রাত এবং দিনে সমানভাবে হেলিকপ্টারযোগে গোলাবারুদ, এমনকি ১০৬ মিঃ মিঃ এণ্টিট্যাঙ্ক গান এবং আর্টিলারীর গোলাবারুদ গেছে। আমরা ঐ অঞ্চলে উপস্থিত থাকতেই দেখলাম যে, একটি হেলিকপ্টার এতে নামল এবং তাতে গোলাবারুদ উঠানো হচ্ছে। ঐ ঘটনা আমার মনে চরম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল। আমার মনে হল, পাকিস্তানীরা মিলিটারী এ্যাকশনে অবস্থা আয়ত্তাধীনে আনছে না বরং মারণযজ্ঞে নেমেছে, কারণ আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়া অতিরিক্ত গোলাবারুদ সৈন্যদের প্রয়োজনে আসে না বা আসার কথা না। ১৯৫৩ সালে লাহোরের মার্শাল ল'এ আমাদের “ফার্স্ট লাইন” বা “পাউচ এম্যুনিশনই” খরচ হয়েছিল না। মনের ভাব মনে চেপে রেখেই সঙ্গে নেওয়া প্লাটুন সমেত ওখান থেকে চলে আসলাম। ফেরার পথে ক্যাপ্টেন রিয়াজের নেতৃত্বে প্লাটুনকে জয়দেবপুর চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলাম এবং আমি গাজীপুর অর্ডন্যান্স ডিপোতে আমার কোম্পানীকে দেখতে গেলাম। সেখানে যেয়ে দেখলাম যে ঐ কোম্পানীও বেশ কিছু শংকাজনিত চিত্তে আছে। ওখানে আরও দেখলাম যে, আমার কোম্পানী ছাড়াও দুই কোম্পানী মত এমওডিসি'র লোক রয়েছে। এদের কাছে অস্ত্র আছে এবং দুই-তিন সপ্তাহের স্বল্প সামরিক শিক্ষা এরা পেয়েছে। এরা সবাই বাঙালী। ওখানে সবাইকে দেখে, কিছু অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে, কিছু গতানুগতিক ভাষণ দিয়ে বেলা এগার সাড়ে এগারটার দিকে জয়দেবপুরে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ফিরে আসলাম। রাস্তাঘাট, বাজার প্রায় জনশূন্য ছিল এবং সকলের ভিতরে একটা ভীতিজনক ভাব ছিল।

 হেডকোয়ার্টারে ফিরে এসে টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহের অবস্থার আরও অবনতির কথা জানতে পারলাম। এ ছাড়াও বিভিন্ন রকমের কথাবার্তাও কানে আসতে থাকল। যেহেতু তখন পর্যন্ত ঐ এলাকার কোন 'অঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটে নাই, আমি অফিসে এসে বসলাম। অফিসে বসার পর সুবেদার নূরুল হক প্রথামত ওখানকার সৈন্যদের সম্বন্ধে সমস্ত খবর দিলেন এবং অন্য দুই জায়গায় খবর আমাকে দিলেন। সকলের কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাবও আমাকে জানালেন। তারা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর ক্যাপ্টেন আজিজ আমার অফিসে এসে বললেন, “আমাদের নিরস্ত্র ভাইয়েরা গুলি খেয়ে শেয়াল-কুকুরের মত মরবে আর আমরা হাতিয়ার হাতে থাকা সত্ত্বেও নীরব দর্শক হয়ে থাকবো?” আমি তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্ট করলাম এই যে, ধৈর্যহীন হয়ো না, সময়মত সব কিছুই করা হবে। তারা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে মেজর মইন আমার অফিস কামরায় ঢুকে একই ধরনের অভিব্যক্তি করলে আমি তাকে একই ধরনের কথা বলি। এর কিছুক্ষণ পরে মেজর শফিউল্লাহকে আমার অফিস কামরায় ডাকি এবং একথা সেকথার পরে তাকে বলি যে আমদের ‘ইয়ং ব্লাড’ বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছে এবং এ অবস্থায় কি করা যেতে পারে। তিনি আমাকে বললেন যে আমাদের উত্তেজিত হওয়া শোভা পায় না; সবকিছু একটু ভেবেচিন্তে করতে হবে। (প্রসঙ্গত এটুকু বলছি যে, আমাদের উপরোক্ত কথোপকথন প্রচলিত ইংরাজী এবং বাংলা দুই ভাষাতে হয়েছে। কথোপকথনের বাংলা অনুবাদ যা দাঁড়ায় তা লিখেছি)। ঐ অবস্থায় দুপুর গড়িয়ে গেল। ঢাকার সঙ্গে কোন সংযোগ নাই বললেই চলে। আনুমানিক তিনটা সাড়ে-তিনটার সময় অয়ারলেসে ব্রিগেড কমাণ্ডার আমার সাথে কথা বললেন। প্রথমে জানতে চাইলেন যে আমদের এদিকের অবস্থা কি। আমি উত্তরে জানালাম যে আমার নিকটবর্তী এলাকায় কোন অঘটন ঘটে নাই। তবে টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহে অবস্থার যথেষ্ট অবনতির খবর পাচ্ছি এবং সেখানকার কোম্পানী কমাণ্ডাররা আরও সৈন্য চাচ্ছেন তাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্যে। তিনি বললেন ওখানে সৈন্য পাঠানোর দরকার নাই, তারা ঐদিকটা দেখবেন। তিনি আরও বললেন যে, “দুষ্কৃতকারীদের শায়েস্তা করা হচ্ছে”-টঙ্গী ব্রিজ বিনষ্ট করে ফেলেছে। ঐ দিন সন্ধ্যায় টঙ্গী এলাকা আর্মি অপারেশন করবে; এক কোম্পানী প্রস্তুত থাকবে, যদি প্রয়োজন হয় তাহলে উত্তর দিক থেকে এসে অপারেশনে সহায়তা করবে। এই খবর দেওয়ার পর যথেষ্ট সংশয় এবং শঙ্কার সৃষ্টি হয়। উদ্বেগাকুল চিত্তে আমরা সন্ধ্যার অপেক্ষায় থাকি।

 ঐ দিন সন্ধ্যায় দূর থেকে অর্থাৎ জয়দেবপুর থেকে টঙ্গীতে আর্মি এ্যাকশনের প্রচণ্ডতায় আমি ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ি। গুলি এবং তোপের আওয়াজ এবং গোলাগুলির শলাকা দেখে আমার মনে হয় পাক আর্মি আইন- শৃঙ্খলা উন্নতির জন্য সরকারকে সাহায্য করছে না, বরং পুরোপুরি বাঙালী হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছে। সারাদিনে বিভিন্ন